॥ এ এম এম বাহাউদ্দীন ॥
নিত্যদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক যুগান্তরের লিড নিউজ ‘কোথায় ছিল এতোদিন’ রির্পোটটি পড়তে হলো। বাংলাদেশ জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে, এদেশের তরুণরা আইএস-এ যোগ দিতে যাচ্ছে এমন খবর যখন কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে; এ ধরণের খবর মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে ঠিকই; তখন ২৭ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরের এ অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের যেন ‘মুখোশ’ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের আইএস এ যোগদান এবং জঙ্গি হয়ে ওঠার ‘কল্পকাহিনী’ যারা মাঝে মাঝে ফাঁদেন তাদের চাতুর্যপনা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে পত্রিকাটি পরিবেশিত তথ্যে।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ের নামে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে; মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের নামে জঙ্গিবাদ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তালেবান, আল কায়দা, আল শাবাব, আল নুসরা ইত্যাদি নামের সংগঠনকে ঠেকানোর নামে গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দমনের নামে লাখো মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে লাখ লাখ ইরাকী সুন্নি সিরিয়া, তুরস্কসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ইরাকের সুন্নি নাগরিক ও বার্থ পার্টির লাখো সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। সুন্নী নারীদের নির্বিচারের ধর্ষণ করা হয় এবং ইরাকের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সেগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মানবাধিকার লংঘন এবং সন্ত্রাসবাদ মনে হয়নি। চীন, ফিলিপাইন, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তানে কি হচ্ছে তাতো মানুষ দেখছে। তখন শিক্ষিত যুবকরা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনকে জানা-বোঝার চেষ্টা করছে। নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে গড়ে তোলার অনুশীলন করছে। আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করছে; প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের গায়ে জঙ্গী লেবেল এঁটে সন্ত্রাস দমনের ধোঁয়া তুলছে। ওবামা আইএসকে (ইসলামিক এস্টেট) দমন করতে হামলা চালিয়েছেন। একশ’ দেশ এই হামলায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো আইএস দমনের নামে নির্বিচার বিমান হামলার ঘোষণা কি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে না? মূলত অর্থ আর অস্ত্রের জোরে বিশ্বের মোড়ল খ্যাত আমেরিকা ও তার ধামাধরা দেশগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় মুসলমানদের উত্থান। বর্তমানে বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমানের বসবাস। পশ্চিমাদের অপরাজনীতি, বিধর্মপনা, বেলেল্লাপনা ও কূটকৌশলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সেসব দেশে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোরআন নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানুষ ইসলামমুখি হচ্ছে; দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনাম করতে কাল্পনিক জঙ্গিবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নির্মম হত্যা, ধ্বংস ও সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
নভেম্বর মাসে আমেরিকার সিনেট নির্বাচন। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ওবামার জনপ্রিয়তা তলানীতি। সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের দেশে দেশে অকল্পনীয় সন্ত্রাস করে নিজ দেশের ভোটারদের বোঝাতে চাচ্ছে তারা দুর্বল নন। ব্রিটেনের ক্যামেরুন ভাল নেই। স্কটল্যা-ের নির্বাচনী ফলাফল মূলত তার পক্ষে যায়নি। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে তিনি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে মাফ চাইবেন। ফ্রান্সের ওঁলাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং সে সব দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে তারা সন্ত্রাস দমন আর মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইরাকে আইএস কি একদিনই জন্ম নিয়েছে? শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে তিন হাজারের বেশী তরুণ যুবক আইএস এ যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং আমেরিকা ব্রিটেনের মানবাধিকারের নমুনা দেখেছেন। আমেরিকার শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং মানবাধিকারের নমুনা দেখে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সে দেশের বিবেকবান মানুষও বিক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছেন। যেভাবে এই অগ্রগতি হচ্ছে তাতে ২০৪০ সালের পূর্বেই আমেরিকায় সাদা চামড়ার ইসলামবিদ্বেষীরা মাইনরিটি হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কি বলে? আমেরিকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি এবং সেখানে প্রতিদিনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। নিজের ঘর সামাল দেয়ার বদলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তান দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, মিসরে আগুন জ্বালিয়েছে। সিরিয়ায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ তাদের সংজ্ঞায় মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক দখল এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি দেয়ার পর সে দেশে যে চরম মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সে জন্য তাদের অনুশোচনা নেই। বীর আফগান জনগণের প্রতিরোধের কারণেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ভারতের জনগণের বিশাল অংশ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা যাওয়ার আগে মুসলমানদের ব্যাপারে তার ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন। জর্ডানে যারা ইরাক সিরিয়া থেকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সংখ্যা জর্ডানের মূল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ইসলাম প্রেমী এবং মুসলমানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে সেখানে বাড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশগুলোতে সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সমকামী মানসিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, লাম্পট্য বেড়ে যাওয়ায় সাদা চামড়ার জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব দেখে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকরা ইসলামের ছায়াতলে আসছে দলে দলে। এরাই মূলত সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সিরিয়ার শিয়া-সুন্নি বিরোধ আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। সে জন্য সেখানে আসাদ বাহিনীর হাতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও তারা মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। মাত্র ৭% শিয়া আল ওয়াইদ এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক সুন্নীকে হত্যা করেছে। ৯৩ ভাগ মানুষকে এই সংখ্যালঘুরা যেভাবে জুলুম করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইরাকের আইএস ইস্যু রাজনৈতিক সংকট। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয়, আইএস স্কুল পুড়িয়েছে, সাংবাদিকের শিরñেদ করেছে, এগুলো গর্হিত কাজ। সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের কি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেছে? তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লাখো মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই যে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন এসব সা¤্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আইএস জুলুম-নির্যাতন সহ্যের এক পর্যায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওবামার নেতৃত্বে ১শ দেশ অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্ত করেছে এটা কেমন মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য মার্কিনিদের দরদ যেন উথলে পড়ছে। অথচ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে; তাদের বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বের ১৬টি দেশে ১৫৬টি সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠনের খেতাব দিয়েছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলোই তারাই সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। যখন ওই সংগঠনগুলো সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানছে তখন সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দমনের চেষ্টা করছে। মূলত আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের সংকট থেকে উত্তরণ এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে দেশে দেশে মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। জঙ্গির ধুয়া তুলে মুসলমানদের ওপর বোমা হামলা, বিমান হামলা করে মুসলিম নিধন করেন। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তাদের অধিনস্ত এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে এ নীতি চালিয়ে আসছে ইসলামবিদ্বেষীরা। আমরা সে ফাঁদে পা দেব কেন?
আল কায়দার মুখপাত্র আয়মান আল জাওহিরির একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। সেখানে তিনি এশিয়ায় সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ে’ এই তাদের দ্বিমুখী নীতি তাদের। জাওহিরির এ ঘোষণার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষ্যে সত্যিই দুরূহ। এটি সরকারকেই নিরূপণ করতে হবে। এ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি গ্রেফতার শুরু হয়। যুগান্তরের খবরের শিরোনামটি প্রণিধানযোগ্য। তারা লিখেছে ‘কোথায় ছিল এতোদিন’। সত্যিই অবাক করা প্রশ্ন। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলা ভিশনের এক টকশোতে বলেছেন, বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে হঠাৎ করে অস্ত্র উদ্ধার আর জঙ্গি গ্রেফতারের হিড়িক পড়েছিল। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগে জঙ্গি ধরা শুরু হয়। আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেও অস্ত্র উদ্ধারের মহড়া হয়। আসিফ নজরুলের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিশ্ব রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশ নয়। ইসলামবিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদীদের কূটচাল বাংলাদেশ নিয়েও দীর্ঘদিন থেকে চলছে। হঠাৎ করে কাউকে গ্রেফতার করে আইএস সদস্য হিসেবে প্রচার করা এবং চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের ধুঁয়া তুললেও এদেশে বাস্তবিকই জঙ্গিবাদ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য জঙ্গিবাদ রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। তাহলে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা কি নিজেরাই দেশে রেড এলার্ট জারী করছি না? বাংলাটিম, আনসারুল্লা, হুজি, জেএমবি, আইএস সদস্য হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পিতা এবং পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাদের সন্তানরা কখনোই জঙ্গী নয়। এমনকি একজন স্কুল শিক্ষক বলেছেন তার ছেলে খুবই ভীতু প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, তার ছেলে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যায়। সে কখনো জঙ্গি হতে পারে না। দু’জন পিতা বলেছেন, আমাদের ছেলেদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি ছিল না। দীর্ঘদিন আটকের পর যখন জঙ্গি হিসেবে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি। আরেক বিচারপতি আব্দুস সালাম তার ছেলে গ্রেফতারের পর বলেছেন, গ্রেফতার করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য তরুণদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ছেলে জঙ্গি বা আইএস সদস্য এমন অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। এ সব শুনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সকল অভিভাবকের কাছেই তাদের সন্তানরা নিরাপরাধ। কখন কে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা অনেক অভিভাবকই জানেন না। যারা এখন দাবি করছেন তাদের ছেলে নিরপরাধ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব ও একজন বিচারপতিও তার ছেলে জঙ্গি এমন খবরে বিস্মিত হয়েছে। আজ যে কর্মকর্তা ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তরুণদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয় দিচ্ছেন; কাল তার ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে না বা কেউ ষড়যন্ত্র করে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে একমত হয়ে বিশ্বের বহুদেশ এখন আইএস দমনে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলা, দ্বিমত প্রকাশ করা বা বিকল্প কোন চিন্তাভাবনা মনে হয়, অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ আইএসের নামটি নিলেই তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী। এরি মধ্যে পশ্চিমা জগতে অনেক লেখক, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক যতটুকু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা লেখালেখি করতে পারেন তার এক শতাংশও আরব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্ভব হয় না। পশ্চিমাদের এ সৌন্দর্য্য অনুন্নত বিশ্বে ঢাকা পড়ে যায় গোলামি সূলভ মানসিকতার কালো ছায়ায়। ব্রিটেনের এমপি রুশনারা আলী শ্যাডো মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই নেত্রী মূলত ব্রিটেনের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ও লন্ডনের জনমত, মুসলিম অনুভূতি এবং নিজ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে গত রমজানে গাজায় ফিলিস্তিনি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করেছিলেন ব্রিটেনের সহকারী মন্ত্রী সাইয়েদা সাঈদা ওয়ার্সি। সাইয়েদা ওয়ার্সি ও রুশনারা আলী দু’জনেরই পদত্যাগের কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ ও প্রতিবাদ। ওয়ার্সি গাজা প্রশ্নে ব্রিটেনের অস্পষ্ট নীতি আর রুশনারা আইএস নিমূর্লের যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের এ দুই তরুণী রাজনীতিকের মনোভাব যে গোটা বিশ্বের ন্যায়পন্থী নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন নয়, সেটাই বা কে বলবে? যে কোন ব্যানারে সংগ্রামরত মজলুম মানুষের ব্যাপারে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের রীতি আচরণ ও কর্মপদ্ধতি কি এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত কর্মকৌশলই কি অধিক ফলপ্রসূ না? এ নিয়ে পলিসি গবেষকরা যদি নতুন করে চিন্তাভাবনা না করেন তাহলে জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ শেষ না হয়ে বরং আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংক্ষুব্ধ মানবগোষ্ঠীর প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, মন্দের প্রতিবিধান করো ভালো দিয়ে। এতে তোমার শত্রু পরিণত হবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে। আর শত্রুকে বন্ধুরূপে তারাই পায় যারা ধৈর্য ধারণ করেন এবং যার জন্য নির্ধারিত আছে উত্তম নিয়তি। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জীবন সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠকে বিশ্বাসী লোকেরাই কি পশ্চিমাদের শত্রু? যদি তাই হয়, তাহলে বার বার বলতে হয় কেন যে, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, জিহাদিদের বিরুদ্ধে? যেখানেই যে অজুহাতেই লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছে তারা তো নিরীহ মুসলমান। বেসামরিক নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রুগীরাও তো রেহাই পায়নি। তাহলে এ ধরনের নীতির প্রতিক্রিয়ায় যদি দেশে দেশে তরুণেরা দুঃখ পায়, প্রভাবিত হয়, সমবেদনা বোধ করে তাহলে কি গ্রেফতার দমন-পীড়ন আর অপমানই এদের পাওনা? সাইবার মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তো রাষ্ট্রপূর্ণ সচেতন হয় না। সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও অব্যাহত জুলুম-নির্যাতন দেখে সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তিরও মনস্তাত্তিক সাপোর্ট, মটিভেশন এবং আদর্শিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিগত দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাই পছন্দ করে এসেছেন। সাজানো মামলা বা আরোপিত ধারায় ছাত্র, তরুণ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধরে মারাত্মক সন্ত্রাসী, জঙ্গি, তালিবান, আইএস ইত্যাদি বলে প্রচার করা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে বরং ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে মটিভেশনের কাজে লাগালে ফল ভালো হবে। অভিযুক্ত লোকেদের নিজ বাবা-মা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সাথে রেখে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ করলে উগ্রবাদ মোকাবেলা সহজ হবে।
বর্তমানে দেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যেখানে সেখানে যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আলেম ওলামা ধর্মীয় পোশাকধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তা ও শিক্ষিত লোকজন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন এবং মাদ্রাসা মসজিদের সঙ্গে জড়িত সেসব নাগরিক চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। খুশির কথা বলো দেশের তরুণ এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। সমাজে যখন উৎশৃংখলতা, আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চার নামে বেলেল্লাপনা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার ঢুকে পড়েছে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনায় উৎসাহী হচ্ছে। যারা ইসলামের দীক্ষায় এবং দ্বীনি পথে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করছেন তাদের জজ মিয়া বানিয়ে নাটক করা কখনোই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে দেশকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ ও সন্ত্রাস মুক্ত করা উচিত। আমি এমনও খবর পেয়েছি অনেক মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারের ভয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি-পাগড়ী পড়িধান না করে কলেজ পড়–য়া ছাত্রের মতো শ্যাট-প্যান্ট পরে বের হচ্ছে। দেশে যে সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং জীবনধারাকে গড্ডালিকায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে; তার চেয়ে শতগুণ বেশি তরুণ-তরুণী নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ও ড্রাগে আসক্ত হয়েছে। যাদের মাদকমুক্ত করে সমাজে সুনাগরিক করার চেয়ে ইসলামের প্রতি আসক্তদের গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়ার প্রতি অধিক মনোনিবেশ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, বিনিয়োগ, পর্যটন, সুনাম ইত্যাদি সবই বিশ্বদরবারে সংকটের সম্মুখিন হবে।
অতি উৎসাহী কিছু লোকের এসব প্রয়াস অতীতেও ছিল, ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর কী হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। অতএব সবার উচিত যথাযথভাবে কাজ করা।
কারো ছেলে যদি সত্যি সত্যি উগ্রবাদী হয়ে যায় এবং কারো স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ে যদি অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তাদের পিতামাতার হাতে তুলে দেয়াই অধিক ফলপ্রসু। তারা যাতে ভাল হয়ে যায় সে প্রতিশ্রুতি নেন এবং ওইসব পিতামাতার প্রতি আস্থা রাখুন। দেখবেন এক সময় তারা ভাল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ইসলামী তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞ লোক নেই। আমেরিকা আর ভারতে ট্রেনিং নিলে সেটা থাকার কথা নয়। ওইসব দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে কিছু লোকের স্বদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগের প্রচারণায় আমাদের দেশের অনেকেরই মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যাতে ওইসব দেশের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশকে বিদেশিদের চারণভূমি না বানিয়ে ফেলি, সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরাকে যারা এখন আইএস সদস্য, তারাই নিরীহ নাগরিক বাথ পার্টির লোকজন, তারা সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ২০০৩ সালের পর তারা কঠোর হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেন। আমার বিশ্বাস, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আমেরিকা প্রেসিডেন্ট ভোটের বৈতরণী পার হতে বর্তমানে যে কৌশল নিয়েছেন নভেম্বরে ভোটের পর তার পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিশ্বের মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিন্তাশীল মানুষ। তিনি অবশ্যই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। কারণ বর্তমানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর আমার নজরে পড়ে না। কেউ যদি ইসলামী ধ্যান-ধারণার মধ্যে থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে নিজেকে জড়ায় তাদের বোঝাতে হবে মূলত উগ্রাবাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত মানুষ এবং তরুণ যুবকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এদেশের মুসলমানরা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ নেই, তবে দ্বীন, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনো আপোষও নেই।
Source
দেশে হঠাৎ কেন এই আইএস আতঙ্ক
॥ এ এম এম বাহাউদ্দীন ॥
নিত্যদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক যুগান্তরের লিড নিউজ ‘কোথায় ছিল এতোদিন’ রির্পোটটি পড়তে হলো। বাংলাদেশ জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে, এদেশের তরুণরা আইএস-এ যোগ দিতে যাচ্ছে এমন খবর যখন কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে; এ ধরণের খবর মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে ঠিকই; তখন ২৭ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরের এ অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের যেন ‘মুখোশ’ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের আইএস এ যোগদান এবং জঙ্গি হয়ে ওঠার ‘কল্পকাহিনী’ যারা মাঝে মাঝে ফাঁদেন তাদের চাতুর্যপনা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে পত্রিকাটি পরিবেশিত তথ্যে।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ের নামে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে; মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের নামে জঙ্গিবাদ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তালেবান, আল কায়দা, আল শাবাব, আল নুসরা ইত্যাদি নামের সংগঠনকে ঠেকানোর নামে গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দমনের নামে লাখো মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে লাখ লাখ ইরাকী সুন্নি সিরিয়া, তুরস্কসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ইরাকের সুন্নি নাগরিক ও বার্থ পার্টির লাখো সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। সুন্নী নারীদের নির্বিচারের ধর্ষণ করা হয় এবং ইরাকের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সেগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মানবাধিকার লংঘন এবং সন্ত্রাসবাদ মনে হয়নি। চীন, ফিলিপাইন, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তানে কি হচ্ছে তাতো মানুষ দেখছে। তখন শিক্ষিত যুবকরা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনকে জানা-বোঝার চেষ্টা করছে। নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে গড়ে তোলার অনুশীলন করছে। আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করছে; প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের গায়ে জঙ্গী লেবেল এঁটে সন্ত্রাস দমনের ধোঁয়া তুলছে। ওবামা আইএসকে (ইসলামিক এস্টেট) দমন করতে হামলা চালিয়েছেন। একশ’ দেশ এই হামলায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো আইএস দমনের নামে নির্বিচার বিমান হামলার ঘোষণা কি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে না? মূলত অর্থ আর অস্ত্রের জোরে বিশ্বের মোড়ল খ্যাত আমেরিকা ও তার ধামাধরা দেশগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় মুসলমানদের উত্থান। বর্তমানে বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমানের বসবাস। পশ্চিমাদের অপরাজনীতি, বিধর্মপনা, বেলেল্লাপনা ও কূটকৌশলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সেসব দেশে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোরআন নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানুষ ইসলামমুখি হচ্ছে; দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনাম করতে কাল্পনিক জঙ্গিবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নির্মম হত্যা, ধ্বংস ও সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
নভেম্বর মাসে আমেরিকার সিনেট নির্বাচন। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ওবামার জনপ্রিয়তা তলানীতি। সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের দেশে দেশে অকল্পনীয় সন্ত্রাস করে নিজ দেশের ভোটারদের বোঝাতে চাচ্ছে তারা দুর্বল নন। ব্রিটেনের ক্যামেরুন ভাল নেই। স্কটল্যা-ের নির্বাচনী ফলাফল মূলত তার পক্ষে যায়নি। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে তিনি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে মাফ চাইবেন। ফ্রান্সের ওঁলাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং সে সব দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে তারা সন্ত্রাস দমন আর মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইরাকে আইএস কি একদিনই জন্ম নিয়েছে? শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে তিন হাজারের বেশী তরুণ যুবক আইএস এ যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং আমেরিকা ব্রিটেনের মানবাধিকারের নমুনা দেখেছেন। আমেরিকার শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং মানবাধিকারের নমুনা দেখে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সে দেশের বিবেকবান মানুষও বিক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছেন। যেভাবে এই অগ্রগতি হচ্ছে তাতে ২০৪০ সালের পূর্বেই আমেরিকায় সাদা চামড়ার ইসলামবিদ্বেষীরা মাইনরিটি হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কি বলে? আমেরিকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি এবং সেখানে প্রতিদিনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। নিজের ঘর সামাল দেয়ার বদলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তান দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, মিসরে আগুন জ্বালিয়েছে। সিরিয়ায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ তাদের সংজ্ঞায় মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক দখল এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি দেয়ার পর সে দেশে যে চরম মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সে জন্য তাদের অনুশোচনা নেই। বীর আফগান জনগণের প্রতিরোধের কারণেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ভারতের জনগণের বিশাল অংশ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা যাওয়ার আগে মুসলমানদের ব্যাপারে তার ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন। জর্ডানে যারা ইরাক সিরিয়া থেকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সংখ্যা জর্ডানের মূল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ইসলাম প্রেমী এবং মুসলমানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে সেখানে বাড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশগুলোতে সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সমকামী মানসিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, লাম্পট্য বেড়ে যাওয়ায় সাদা চামড়ার জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব দেখে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকরা ইসলামের ছায়াতলে আসছে দলে দলে। এরাই মূলত সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সিরিয়ার শিয়া-সুন্নি বিরোধ আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। সে জন্য সেখানে আসাদ বাহিনীর হাতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও তারা মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। মাত্র ৭% শিয়া আল ওয়াইদ এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক সুন্নীকে হত্যা করেছে। ৯৩ ভাগ মানুষকে এই সংখ্যালঘুরা যেভাবে জুলুম করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইরাকের আইএস ইস্যু রাজনৈতিক সংকট। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয়, আইএস স্কুল পুড়িয়েছে, সাংবাদিকের শিরñেদ করেছে, এগুলো গর্হিত কাজ। সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের কি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেছে? তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লাখো মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই যে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন এসব সা¤্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আইএস জুলুম-নির্যাতন সহ্যের এক পর্যায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওবামার নেতৃত্বে ১শ দেশ অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্ত করেছে এটা কেমন মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য মার্কিনিদের দরদ যেন উথলে পড়ছে। অথচ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে; তাদের বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বের ১৬টি দেশে ১৫৬টি সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠনের খেতাব দিয়েছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলোই তারাই সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। যখন ওই সংগঠনগুলো সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানছে তখন সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দমনের চেষ্টা করছে। মূলত আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের সংকট থেকে উত্তরণ এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে দেশে দেশে মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। জঙ্গির ধুয়া তুলে মুসলমানদের ওপর বোমা হামলা, বিমান হামলা করে মুসলিম নিধন করেন। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তাদের অধিনস্ত এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে এ নীতি চালিয়ে আসছে ইসলামবিদ্বেষীরা। আমরা সে ফাঁদে পা দেব কেন?
আল কায়দার মুখপাত্র আয়মান আল জাওহিরির একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। সেখানে তিনি এশিয়ায় সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ে’ এই তাদের দ্বিমুখী নীতি তাদের। জাওহিরির এ ঘোষণার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষ্যে সত্যিই দুরূহ। এটি সরকারকেই নিরূপণ করতে হবে। এ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি গ্রেফতার শুরু হয়। যুগান্তরের খবরের শিরোনামটি প্রণিধানযোগ্য। তারা লিখেছে ‘কোথায় ছিল এতোদিন’। সত্যিই অবাক করা প্রশ্ন। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলা ভিশনের এক টকশোতে বলেছেন, বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে হঠাৎ করে অস্ত্র উদ্ধার আর জঙ্গি গ্রেফতারের হিড়িক পড়েছিল। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগে জঙ্গি ধরা শুরু হয়। আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেও অস্ত্র উদ্ধারের মহড়া হয়। আসিফ নজরুলের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিশ্ব রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশ নয়। ইসলামবিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদীদের কূটচাল বাংলাদেশ নিয়েও দীর্ঘদিন থেকে চলছে। হঠাৎ করে কাউকে গ্রেফতার করে আইএস সদস্য হিসেবে প্রচার করা এবং চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের ধুঁয়া তুললেও এদেশে বাস্তবিকই জঙ্গিবাদ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য জঙ্গিবাদ রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। তাহলে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা কি নিজেরাই দেশে রেড এলার্ট জারী করছি না? বাংলাটিম, আনসারুল্লা, হুজি, জেএমবি, আইএস সদস্য হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পিতা এবং পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাদের সন্তানরা কখনোই জঙ্গী নয়। এমনকি একজন স্কুল শিক্ষক বলেছেন তার ছেলে খুবই ভীতু প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, তার ছেলে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যায়। সে কখনো জঙ্গি হতে পারে না। দু’জন পিতা বলেছেন, আমাদের ছেলেদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি ছিল না। দীর্ঘদিন আটকের পর যখন জঙ্গি হিসেবে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি। আরেক বিচারপতি আব্দুস সালাম তার ছেলে গ্রেফতারের পর বলেছেন, গ্রেফতার করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য তরুণদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ছেলে জঙ্গি বা আইএস সদস্য এমন অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। এ সব শুনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সকল অভিভাবকের কাছেই তাদের সন্তানরা নিরাপরাধ। কখন কে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা অনেক অভিভাবকই জানেন না। যারা এখন দাবি করছেন তাদের ছেলে নিরপরাধ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব ও একজন বিচারপতিও তার ছেলে জঙ্গি এমন খবরে বিস্মিত হয়েছে। আজ যে কর্মকর্তা ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তরুণদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয় দিচ্ছেন; কাল তার ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে না বা কেউ ষড়যন্ত্র করে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে একমত হয়ে বিশ্বের বহুদেশ এখন আইএস দমনে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলা, দ্বিমত প্রকাশ করা বা বিকল্প কোন চিন্তাভাবনা মনে হয়, অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ আইএসের নামটি নিলেই তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী। এরি মধ্যে পশ্চিমা জগতে অনেক লেখক, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক যতটুকু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা লেখালেখি করতে পারেন তার এক শতাংশও আরব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্ভব হয় না। পশ্চিমাদের এ সৌন্দর্য্য অনুন্নত বিশ্বে ঢাকা পড়ে যায় গোলামি সূলভ মানসিকতার কালো ছায়ায়। ব্রিটেনের এমপি রুশনারা আলী শ্যাডো মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই নেত্রী মূলত ব্রিটেনের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ও লন্ডনের জনমত, মুসলিম অনুভূতি এবং নিজ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে গত রমজানে গাজায় ফিলিস্তিনি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করেছিলেন ব্রিটেনের সহকারী মন্ত্রী সাইয়েদা সাঈদা ওয়ার্সি। সাইয়েদা ওয়ার্সি ও রুশনারা আলী দু’জনেরই পদত্যাগের কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ ও প্রতিবাদ। ওয়ার্সি গাজা প্রশ্নে ব্রিটেনের অস্পষ্ট নীতি আর রুশনারা আইএস নিমূর্লের যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের এ দুই তরুণী রাজনীতিকের মনোভাব যে গোটা বিশ্বের ন্যায়পন্থী নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন নয়, সেটাই বা কে বলবে? যে কোন ব্যানারে সংগ্রামরত মজলুম মানুষের ব্যাপারে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের রীতি আচরণ ও কর্মপদ্ধতি কি এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত কর্মকৌশলই কি অধিক ফলপ্রসূ না? এ নিয়ে পলিসি গবেষকরা যদি নতুন করে চিন্তাভাবনা না করেন তাহলে জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ শেষ না হয়ে বরং আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংক্ষুব্ধ মানবগোষ্ঠীর প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, মন্দের প্রতিবিধান করো ভালো দিয়ে। এতে তোমার শত্রু পরিণত হবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে। আর শত্রুকে বন্ধুরূপে তারাই পায় যারা ধৈর্য ধারণ করেন এবং যার জন্য নির্ধারিত আছে উত্তম নিয়তি। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জীবন সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠকে বিশ্বাসী লোকেরাই কি পশ্চিমাদের শত্রু? যদি তাই হয়, তাহলে বার বার বলতে হয় কেন যে, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, জিহাদিদের বিরুদ্ধে? যেখানেই যে অজুহাতেই লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছে তারা তো নিরীহ মুসলমান। বেসামরিক নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রুগীরাও তো রেহাই পায়নি। তাহলে এ ধরনের নীতির প্রতিক্রিয়ায় যদি দেশে দেশে তরুণেরা দুঃখ পায়, প্রভাবিত হয়, সমবেদনা বোধ করে তাহলে কি গ্রেফতার দমন-পীড়ন আর অপমানই এদের পাওনা? সাইবার মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তো রাষ্ট্রপূর্ণ সচেতন হয় না। সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও অব্যাহত জুলুম-নির্যাতন দেখে সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তিরও মনস্তাত্তিক সাপোর্ট, মটিভেশন এবং আদর্শিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিগত দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাই পছন্দ করে এসেছেন। সাজানো মামলা বা আরোপিত ধারায় ছাত্র, তরুণ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধরে মারাত্মক সন্ত্রাসী, জঙ্গি, তালিবান, আইএস ইত্যাদি বলে প্রচার করা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে বরং ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে মটিভেশনের কাজে লাগালে ফল ভালো হবে। অভিযুক্ত লোকেদের নিজ বাবা-মা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সাথে রেখে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ করলে উগ্রবাদ মোকাবেলা সহজ হবে।
বর্তমানে দেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যেখানে সেখানে যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আলেম ওলামা ধর্মীয় পোশাকধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তা ও শিক্ষিত লোকজন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন এবং মাদ্রাসা মসজিদের সঙ্গে জড়িত সেসব নাগরিক চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। খুশির কথা বলো দেশের তরুণ এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। সমাজে যখন উৎশৃংখলতা, আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চার নামে বেলেল্লাপনা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার ঢুকে পড়েছে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনায় উৎসাহী হচ্ছে। যারা ইসলামের দীক্ষায় এবং দ্বীনি পথে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করছেন তাদের জজ মিয়া বানিয়ে নাটক করা কখনোই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে দেশকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ ও সন্ত্রাস মুক্ত করা উচিত। আমি এমনও খবর পেয়েছি অনেক মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারের ভয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি-পাগড়ী পড়িধান না করে কলেজ পড়–য়া ছাত্রের মতো শ্যাট-প্যান্ট পরে বের হচ্ছে। দেশে যে সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং জীবনধারাকে গড্ডালিকায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে; তার চেয়ে শতগুণ বেশি তরুণ-তরুণী নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ও ড্রাগে আসক্ত হয়েছে। যাদের মাদকমুক্ত করে সমাজে সুনাগরিক করার চেয়ে ইসলামের প্রতি আসক্তদের গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়ার প্রতি অধিক মনোনিবেশ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, বিনিয়োগ, পর্যটন, সুনাম ইত্যাদি সবই বিশ্বদরবারে সংকটের সম্মুখিন হবে।
অতি উৎসাহী কিছু লোকের এসব প্রয়াস অতীতেও ছিল, ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর কী হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। অতএব সবার উচিত যথাযথভাবে কাজ করা।
কারো ছেলে যদি সত্যি সত্যি উগ্রবাদী হয়ে যায় এবং কারো স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ে যদি অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তাদের পিতামাতার হাতে তুলে দেয়াই অধিক ফলপ্রসু। তারা যাতে ভাল হয়ে যায় সে প্রতিশ্রুতি নেন এবং ওইসব পিতামাতার প্রতি আস্থা রাখুন। দেখবেন এক সময় তারা ভাল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ইসলামী তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞ লোক নেই। আমেরিকা আর ভারতে ট্রেনিং নিলে সেটা থাকার কথা নয়। ওইসব দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে কিছু লোকের স্বদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগের প্রচারণায় আমাদের দেশের অনেকেরই মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যাতে ওইসব দেশের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশকে বিদেশিদের চারণভূমি না বানিয়ে ফেলি, সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরাকে যারা এখন আইএস সদস্য, তারাই নিরীহ নাগরিক বাথ পার্টির লোকজন, তারা সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ২০০৩ সালের পর তারা কঠোর হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেন। আমার বিশ্বাস, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আমেরিকা প্রেসিডেন্ট ভোটের বৈতরণী পার হতে বর্তমানে যে কৌশল নিয়েছেন নভেম্বরে ভোটের পর তার পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিশ্বের মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিন্তাশীল মানুষ। তিনি অবশ্যই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। কারণ বর্তমানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর আমার নজরে পড়ে না। কেউ যদি ইসলামী ধ্যান-ধারণার মধ্যে থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে নিজেকে জড়ায় তাদের বোঝাতে হবে মূলত উগ্রাবাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত মানুষ এবং তরুণ যুবকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এদেশের মুসলমানরা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ নেই, তবে দ্বীন, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনো আপোষও নেই।
- See more at: http://dailyinqilab.com/2014/09/28/209039.php#sthash.QoCwcINC.dpufনিত্যদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক যুগান্তরের লিড নিউজ ‘কোথায় ছিল এতোদিন’ রির্পোটটি পড়তে হলো। বাংলাদেশ জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে, এদেশের তরুণরা আইএস-এ যোগ দিতে যাচ্ছে এমন খবর যখন কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে; এ ধরণের খবর মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে ঠিকই; তখন ২৭ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরের এ অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের যেন ‘মুখোশ’ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের আইএস এ যোগদান এবং জঙ্গি হয়ে ওঠার ‘কল্পকাহিনী’ যারা মাঝে মাঝে ফাঁদেন তাদের চাতুর্যপনা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে পত্রিকাটি পরিবেশিত তথ্যে।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ের নামে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে; মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের নামে জঙ্গিবাদ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তালেবান, আল কায়দা, আল শাবাব, আল নুসরা ইত্যাদি নামের সংগঠনকে ঠেকানোর নামে গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দমনের নামে লাখো মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে লাখ লাখ ইরাকী সুন্নি সিরিয়া, তুরস্কসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ইরাকের সুন্নি নাগরিক ও বার্থ পার্টির লাখো সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। সুন্নী নারীদের নির্বিচারের ধর্ষণ করা হয় এবং ইরাকের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সেগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মানবাধিকার লংঘন এবং সন্ত্রাসবাদ মনে হয়নি। চীন, ফিলিপাইন, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তানে কি হচ্ছে তাতো মানুষ দেখছে। তখন শিক্ষিত যুবকরা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনকে জানা-বোঝার চেষ্টা করছে। নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে গড়ে তোলার অনুশীলন করছে। আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করছে; প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের গায়ে জঙ্গী লেবেল এঁটে সন্ত্রাস দমনের ধোঁয়া তুলছে। ওবামা আইএসকে (ইসলামিক এস্টেট) দমন করতে হামলা চালিয়েছেন। একশ’ দেশ এই হামলায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো আইএস দমনের নামে নির্বিচার বিমান হামলার ঘোষণা কি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে না? মূলত অর্থ আর অস্ত্রের জোরে বিশ্বের মোড়ল খ্যাত আমেরিকা ও তার ধামাধরা দেশগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় মুসলমানদের উত্থান। বর্তমানে বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমানের বসবাস। পশ্চিমাদের অপরাজনীতি, বিধর্মপনা, বেলেল্লাপনা ও কূটকৌশলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সেসব দেশে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোরআন নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানুষ ইসলামমুখি হচ্ছে; দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনাম করতে কাল্পনিক জঙ্গিবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নির্মম হত্যা, ধ্বংস ও সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
নভেম্বর মাসে আমেরিকার সিনেট নির্বাচন। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ওবামার জনপ্রিয়তা তলানীতি। সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের দেশে দেশে অকল্পনীয় সন্ত্রাস করে নিজ দেশের ভোটারদের বোঝাতে চাচ্ছে তারা দুর্বল নন। ব্রিটেনের ক্যামেরুন ভাল নেই। স্কটল্যা-ের নির্বাচনী ফলাফল মূলত তার পক্ষে যায়নি। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে তিনি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে মাফ চাইবেন। ফ্রান্সের ওঁলাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং সে সব দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে তারা সন্ত্রাস দমন আর মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইরাকে আইএস কি একদিনই জন্ম নিয়েছে? শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে তিন হাজারের বেশী তরুণ যুবক আইএস এ যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং আমেরিকা ব্রিটেনের মানবাধিকারের নমুনা দেখেছেন। আমেরিকার শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং মানবাধিকারের নমুনা দেখে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সে দেশের বিবেকবান মানুষও বিক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছেন। যেভাবে এই অগ্রগতি হচ্ছে তাতে ২০৪০ সালের পূর্বেই আমেরিকায় সাদা চামড়ার ইসলামবিদ্বেষীরা মাইনরিটি হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কি বলে? আমেরিকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি এবং সেখানে প্রতিদিনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। নিজের ঘর সামাল দেয়ার বদলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তান দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, মিসরে আগুন জ্বালিয়েছে। সিরিয়ায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ তাদের সংজ্ঞায় মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক দখল এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি দেয়ার পর সে দেশে যে চরম মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সে জন্য তাদের অনুশোচনা নেই। বীর আফগান জনগণের প্রতিরোধের কারণেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ভারতের জনগণের বিশাল অংশ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা যাওয়ার আগে মুসলমানদের ব্যাপারে তার ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন। জর্ডানে যারা ইরাক সিরিয়া থেকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সংখ্যা জর্ডানের মূল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ইসলাম প্রেমী এবং মুসলমানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে সেখানে বাড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশগুলোতে সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সমকামী মানসিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, লাম্পট্য বেড়ে যাওয়ায় সাদা চামড়ার জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব দেখে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকরা ইসলামের ছায়াতলে আসছে দলে দলে। এরাই মূলত সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সিরিয়ার শিয়া-সুন্নি বিরোধ আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। সে জন্য সেখানে আসাদ বাহিনীর হাতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও তারা মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। মাত্র ৭% শিয়া আল ওয়াইদ এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক সুন্নীকে হত্যা করেছে। ৯৩ ভাগ মানুষকে এই সংখ্যালঘুরা যেভাবে জুলুম করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইরাকের আইএস ইস্যু রাজনৈতিক সংকট। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয়, আইএস স্কুল পুড়িয়েছে, সাংবাদিকের শিরñেদ করেছে, এগুলো গর্হিত কাজ। সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের কি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেছে? তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লাখো মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই যে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন এসব সা¤্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আইএস জুলুম-নির্যাতন সহ্যের এক পর্যায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওবামার নেতৃত্বে ১শ দেশ অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্ত করেছে এটা কেমন মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য মার্কিনিদের দরদ যেন উথলে পড়ছে। অথচ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে; তাদের বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বের ১৬টি দেশে ১৫৬টি সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠনের খেতাব দিয়েছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলোই তারাই সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। যখন ওই সংগঠনগুলো সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানছে তখন সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দমনের চেষ্টা করছে। মূলত আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের সংকট থেকে উত্তরণ এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে দেশে দেশে মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। জঙ্গির ধুয়া তুলে মুসলমানদের ওপর বোমা হামলা, বিমান হামলা করে মুসলিম নিধন করেন। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তাদের অধিনস্ত এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে এ নীতি চালিয়ে আসছে ইসলামবিদ্বেষীরা। আমরা সে ফাঁদে পা দেব কেন?
আল কায়দার মুখপাত্র আয়মান আল জাওহিরির একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। সেখানে তিনি এশিয়ায় সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ে’ এই তাদের দ্বিমুখী নীতি তাদের। জাওহিরির এ ঘোষণার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষ্যে সত্যিই দুরূহ। এটি সরকারকেই নিরূপণ করতে হবে। এ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি গ্রেফতার শুরু হয়। যুগান্তরের খবরের শিরোনামটি প্রণিধানযোগ্য। তারা লিখেছে ‘কোথায় ছিল এতোদিন’। সত্যিই অবাক করা প্রশ্ন। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলা ভিশনের এক টকশোতে বলেছেন, বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে হঠাৎ করে অস্ত্র উদ্ধার আর জঙ্গি গ্রেফতারের হিড়িক পড়েছিল। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগে জঙ্গি ধরা শুরু হয়। আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেও অস্ত্র উদ্ধারের মহড়া হয়। আসিফ নজরুলের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিশ্ব রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশ নয়। ইসলামবিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদীদের কূটচাল বাংলাদেশ নিয়েও দীর্ঘদিন থেকে চলছে। হঠাৎ করে কাউকে গ্রেফতার করে আইএস সদস্য হিসেবে প্রচার করা এবং চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের ধুঁয়া তুললেও এদেশে বাস্তবিকই জঙ্গিবাদ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য জঙ্গিবাদ রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। তাহলে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা কি নিজেরাই দেশে রেড এলার্ট জারী করছি না? বাংলাটিম, আনসারুল্লা, হুজি, জেএমবি, আইএস সদস্য হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পিতা এবং পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাদের সন্তানরা কখনোই জঙ্গী নয়। এমনকি একজন স্কুল শিক্ষক বলেছেন তার ছেলে খুবই ভীতু প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, তার ছেলে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যায়। সে কখনো জঙ্গি হতে পারে না। দু’জন পিতা বলেছেন, আমাদের ছেলেদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি ছিল না। দীর্ঘদিন আটকের পর যখন জঙ্গি হিসেবে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি। আরেক বিচারপতি আব্দুস সালাম তার ছেলে গ্রেফতারের পর বলেছেন, গ্রেফতার করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য তরুণদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ছেলে জঙ্গি বা আইএস সদস্য এমন অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। এ সব শুনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সকল অভিভাবকের কাছেই তাদের সন্তানরা নিরাপরাধ। কখন কে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা অনেক অভিভাবকই জানেন না। যারা এখন দাবি করছেন তাদের ছেলে নিরপরাধ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব ও একজন বিচারপতিও তার ছেলে জঙ্গি এমন খবরে বিস্মিত হয়েছে। আজ যে কর্মকর্তা ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তরুণদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয় দিচ্ছেন; কাল তার ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে না বা কেউ ষড়যন্ত্র করে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে একমত হয়ে বিশ্বের বহুদেশ এখন আইএস দমনে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলা, দ্বিমত প্রকাশ করা বা বিকল্প কোন চিন্তাভাবনা মনে হয়, অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ আইএসের নামটি নিলেই তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী। এরি মধ্যে পশ্চিমা জগতে অনেক লেখক, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক যতটুকু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা লেখালেখি করতে পারেন তার এক শতাংশও আরব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্ভব হয় না। পশ্চিমাদের এ সৌন্দর্য্য অনুন্নত বিশ্বে ঢাকা পড়ে যায় গোলামি সূলভ মানসিকতার কালো ছায়ায়। ব্রিটেনের এমপি রুশনারা আলী শ্যাডো মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই নেত্রী মূলত ব্রিটেনের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ও লন্ডনের জনমত, মুসলিম অনুভূতি এবং নিজ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে গত রমজানে গাজায় ফিলিস্তিনি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করেছিলেন ব্রিটেনের সহকারী মন্ত্রী সাইয়েদা সাঈদা ওয়ার্সি। সাইয়েদা ওয়ার্সি ও রুশনারা আলী দু’জনেরই পদত্যাগের কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ ও প্রতিবাদ। ওয়ার্সি গাজা প্রশ্নে ব্রিটেনের অস্পষ্ট নীতি আর রুশনারা আইএস নিমূর্লের যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের এ দুই তরুণী রাজনীতিকের মনোভাব যে গোটা বিশ্বের ন্যায়পন্থী নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন নয়, সেটাই বা কে বলবে? যে কোন ব্যানারে সংগ্রামরত মজলুম মানুষের ব্যাপারে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের রীতি আচরণ ও কর্মপদ্ধতি কি এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত কর্মকৌশলই কি অধিক ফলপ্রসূ না? এ নিয়ে পলিসি গবেষকরা যদি নতুন করে চিন্তাভাবনা না করেন তাহলে জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ শেষ না হয়ে বরং আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংক্ষুব্ধ মানবগোষ্ঠীর প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, মন্দের প্রতিবিধান করো ভালো দিয়ে। এতে তোমার শত্রু পরিণত হবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে। আর শত্রুকে বন্ধুরূপে তারাই পায় যারা ধৈর্য ধারণ করেন এবং যার জন্য নির্ধারিত আছে উত্তম নিয়তি। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জীবন সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠকে বিশ্বাসী লোকেরাই কি পশ্চিমাদের শত্রু? যদি তাই হয়, তাহলে বার বার বলতে হয় কেন যে, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, জিহাদিদের বিরুদ্ধে? যেখানেই যে অজুহাতেই লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছে তারা তো নিরীহ মুসলমান। বেসামরিক নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রুগীরাও তো রেহাই পায়নি। তাহলে এ ধরনের নীতির প্রতিক্রিয়ায় যদি দেশে দেশে তরুণেরা দুঃখ পায়, প্রভাবিত হয়, সমবেদনা বোধ করে তাহলে কি গ্রেফতার দমন-পীড়ন আর অপমানই এদের পাওনা? সাইবার মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তো রাষ্ট্রপূর্ণ সচেতন হয় না। সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও অব্যাহত জুলুম-নির্যাতন দেখে সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তিরও মনস্তাত্তিক সাপোর্ট, মটিভেশন এবং আদর্শিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিগত দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাই পছন্দ করে এসেছেন। সাজানো মামলা বা আরোপিত ধারায় ছাত্র, তরুণ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধরে মারাত্মক সন্ত্রাসী, জঙ্গি, তালিবান, আইএস ইত্যাদি বলে প্রচার করা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে বরং ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে মটিভেশনের কাজে লাগালে ফল ভালো হবে। অভিযুক্ত লোকেদের নিজ বাবা-মা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সাথে রেখে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ করলে উগ্রবাদ মোকাবেলা সহজ হবে।
বর্তমানে দেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যেখানে সেখানে যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আলেম ওলামা ধর্মীয় পোশাকধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তা ও শিক্ষিত লোকজন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন এবং মাদ্রাসা মসজিদের সঙ্গে জড়িত সেসব নাগরিক চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। খুশির কথা বলো দেশের তরুণ এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। সমাজে যখন উৎশৃংখলতা, আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চার নামে বেলেল্লাপনা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার ঢুকে পড়েছে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনায় উৎসাহী হচ্ছে। যারা ইসলামের দীক্ষায় এবং দ্বীনি পথে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করছেন তাদের জজ মিয়া বানিয়ে নাটক করা কখনোই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে দেশকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ ও সন্ত্রাস মুক্ত করা উচিত। আমি এমনও খবর পেয়েছি অনেক মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারের ভয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি-পাগড়ী পড়িধান না করে কলেজ পড়–য়া ছাত্রের মতো শ্যাট-প্যান্ট পরে বের হচ্ছে। দেশে যে সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং জীবনধারাকে গড্ডালিকায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে; তার চেয়ে শতগুণ বেশি তরুণ-তরুণী নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ও ড্রাগে আসক্ত হয়েছে। যাদের মাদকমুক্ত করে সমাজে সুনাগরিক করার চেয়ে ইসলামের প্রতি আসক্তদের গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়ার প্রতি অধিক মনোনিবেশ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, বিনিয়োগ, পর্যটন, সুনাম ইত্যাদি সবই বিশ্বদরবারে সংকটের সম্মুখিন হবে।
অতি উৎসাহী কিছু লোকের এসব প্রয়াস অতীতেও ছিল, ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর কী হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। অতএব সবার উচিত যথাযথভাবে কাজ করা।
কারো ছেলে যদি সত্যি সত্যি উগ্রবাদী হয়ে যায় এবং কারো স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ে যদি অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তাদের পিতামাতার হাতে তুলে দেয়াই অধিক ফলপ্রসু। তারা যাতে ভাল হয়ে যায় সে প্রতিশ্রুতি নেন এবং ওইসব পিতামাতার প্রতি আস্থা রাখুন। দেখবেন এক সময় তারা ভাল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ইসলামী তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞ লোক নেই। আমেরিকা আর ভারতে ট্রেনিং নিলে সেটা থাকার কথা নয়। ওইসব দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে কিছু লোকের স্বদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগের প্রচারণায় আমাদের দেশের অনেকেরই মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যাতে ওইসব দেশের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশকে বিদেশিদের চারণভূমি না বানিয়ে ফেলি, সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরাকে যারা এখন আইএস সদস্য, তারাই নিরীহ নাগরিক বাথ পার্টির লোকজন, তারা সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ২০০৩ সালের পর তারা কঠোর হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেন। আমার বিশ্বাস, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আমেরিকা প্রেসিডেন্ট ভোটের বৈতরণী পার হতে বর্তমানে যে কৌশল নিয়েছেন নভেম্বরে ভোটের পর তার পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিশ্বের মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিন্তাশীল মানুষ। তিনি অবশ্যই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। কারণ বর্তমানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর আমার নজরে পড়ে না। কেউ যদি ইসলামী ধ্যান-ধারণার মধ্যে থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে নিজেকে জড়ায় তাদের বোঝাতে হবে মূলত উগ্রাবাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত মানুষ এবং তরুণ যুবকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এদেশের মুসলমানরা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ নেই, তবে দ্বীন, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনো আপোষও নেই।
দেশে হঠাৎ কেন এই আইএস আতঙ্ক
॥ এ এম এম বাহাউদ্দীন ॥
নিত্যদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক যুগান্তরের লিড নিউজ ‘কোথায় ছিল এতোদিন’ রির্পোটটি পড়তে হলো। বাংলাদেশ জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে, এদেশের তরুণরা আইএস-এ যোগ দিতে যাচ্ছে এমন খবর যখন কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে; এ ধরণের খবর মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে ঠিকই; তখন ২৭ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরের এ অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের যেন ‘মুখোশ’ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের আইএস এ যোগদান এবং জঙ্গি হয়ে ওঠার ‘কল্পকাহিনী’ যারা মাঝে মাঝে ফাঁদেন তাদের চাতুর্যপনা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে পত্রিকাটি পরিবেশিত তথ্যে।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ের নামে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে; মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের নামে জঙ্গিবাদ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তালেবান, আল কায়দা, আল শাবাব, আল নুসরা ইত্যাদি নামের সংগঠনকে ঠেকানোর নামে গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দমনের নামে লাখো মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে লাখ লাখ ইরাকী সুন্নি সিরিয়া, তুরস্কসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ইরাকের সুন্নি নাগরিক ও বার্থ পার্টির লাখো সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। সুন্নী নারীদের নির্বিচারের ধর্ষণ করা হয় এবং ইরাকের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সেগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মানবাধিকার লংঘন এবং সন্ত্রাসবাদ মনে হয়নি। চীন, ফিলিপাইন, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তানে কি হচ্ছে তাতো মানুষ দেখছে। তখন শিক্ষিত যুবকরা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনকে জানা-বোঝার চেষ্টা করছে। নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে গড়ে তোলার অনুশীলন করছে। আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করছে; প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের গায়ে জঙ্গী লেবেল এঁটে সন্ত্রাস দমনের ধোঁয়া তুলছে। ওবামা আইএসকে (ইসলামিক এস্টেট) দমন করতে হামলা চালিয়েছেন। একশ’ দেশ এই হামলায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো আইএস দমনের নামে নির্বিচার বিমান হামলার ঘোষণা কি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে না? মূলত অর্থ আর অস্ত্রের জোরে বিশ্বের মোড়ল খ্যাত আমেরিকা ও তার ধামাধরা দেশগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় মুসলমানদের উত্থান। বর্তমানে বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমানের বসবাস। পশ্চিমাদের অপরাজনীতি, বিধর্মপনা, বেলেল্লাপনা ও কূটকৌশলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সেসব দেশে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোরআন নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানুষ ইসলামমুখি হচ্ছে; দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনাম করতে কাল্পনিক জঙ্গিবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নির্মম হত্যা, ধ্বংস ও সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
নভেম্বর মাসে আমেরিকার সিনেট নির্বাচন। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ওবামার জনপ্রিয়তা তলানীতি। সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের দেশে দেশে অকল্পনীয় সন্ত্রাস করে নিজ দেশের ভোটারদের বোঝাতে চাচ্ছে তারা দুর্বল নন। ব্রিটেনের ক্যামেরুন ভাল নেই। স্কটল্যা-ের নির্বাচনী ফলাফল মূলত তার পক্ষে যায়নি। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে তিনি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে মাফ চাইবেন। ফ্রান্সের ওঁলাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং সে সব দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে তারা সন্ত্রাস দমন আর মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইরাকে আইএস কি একদিনই জন্ম নিয়েছে? শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে তিন হাজারের বেশী তরুণ যুবক আইএস এ যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং আমেরিকা ব্রিটেনের মানবাধিকারের নমুনা দেখেছেন। আমেরিকার শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং মানবাধিকারের নমুনা দেখে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সে দেশের বিবেকবান মানুষও বিক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছেন। যেভাবে এই অগ্রগতি হচ্ছে তাতে ২০৪০ সালের পূর্বেই আমেরিকায় সাদা চামড়ার ইসলামবিদ্বেষীরা মাইনরিটি হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কি বলে? আমেরিকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি এবং সেখানে প্রতিদিনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। নিজের ঘর সামাল দেয়ার বদলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তান দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, মিসরে আগুন জ্বালিয়েছে। সিরিয়ায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ তাদের সংজ্ঞায় মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক দখল এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি দেয়ার পর সে দেশে যে চরম মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সে জন্য তাদের অনুশোচনা নেই। বীর আফগান জনগণের প্রতিরোধের কারণেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ভারতের জনগণের বিশাল অংশ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা যাওয়ার আগে মুসলমানদের ব্যাপারে তার ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন। জর্ডানে যারা ইরাক সিরিয়া থেকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সংখ্যা জর্ডানের মূল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ইসলাম প্রেমী এবং মুসলমানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে সেখানে বাড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশগুলোতে সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সমকামী মানসিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, লাম্পট্য বেড়ে যাওয়ায় সাদা চামড়ার জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব দেখে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকরা ইসলামের ছায়াতলে আসছে দলে দলে। এরাই মূলত সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সিরিয়ার শিয়া-সুন্নি বিরোধ আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। সে জন্য সেখানে আসাদ বাহিনীর হাতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও তারা মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। মাত্র ৭% শিয়া আল ওয়াইদ এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক সুন্নীকে হত্যা করেছে। ৯৩ ভাগ মানুষকে এই সংখ্যালঘুরা যেভাবে জুলুম করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইরাকের আইএস ইস্যু রাজনৈতিক সংকট। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয়, আইএস স্কুল পুড়িয়েছে, সাংবাদিকের শিরñেদ করেছে, এগুলো গর্হিত কাজ। সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের কি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেছে? তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লাখো মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই যে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন এসব সা¤্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আইএস জুলুম-নির্যাতন সহ্যের এক পর্যায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওবামার নেতৃত্বে ১শ দেশ অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্ত করেছে এটা কেমন মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য মার্কিনিদের দরদ যেন উথলে পড়ছে। অথচ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে; তাদের বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বের ১৬টি দেশে ১৫৬টি সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠনের খেতাব দিয়েছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলোই তারাই সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। যখন ওই সংগঠনগুলো সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানছে তখন সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দমনের চেষ্টা করছে। মূলত আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের সংকট থেকে উত্তরণ এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে দেশে দেশে মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। জঙ্গির ধুয়া তুলে মুসলমানদের ওপর বোমা হামলা, বিমান হামলা করে মুসলিম নিধন করেন। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তাদের অধিনস্ত এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে এ নীতি চালিয়ে আসছে ইসলামবিদ্বেষীরা। আমরা সে ফাঁদে পা দেব কেন?
আল কায়দার মুখপাত্র আয়মান আল জাওহিরির একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। সেখানে তিনি এশিয়ায় সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ে’ এই তাদের দ্বিমুখী নীতি তাদের। জাওহিরির এ ঘোষণার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষ্যে সত্যিই দুরূহ। এটি সরকারকেই নিরূপণ করতে হবে। এ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি গ্রেফতার শুরু হয়। যুগান্তরের খবরের শিরোনামটি প্রণিধানযোগ্য। তারা লিখেছে ‘কোথায় ছিল এতোদিন’। সত্যিই অবাক করা প্রশ্ন। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলা ভিশনের এক টকশোতে বলেছেন, বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে হঠাৎ করে অস্ত্র উদ্ধার আর জঙ্গি গ্রেফতারের হিড়িক পড়েছিল। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগে জঙ্গি ধরা শুরু হয়। আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেও অস্ত্র উদ্ধারের মহড়া হয়। আসিফ নজরুলের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিশ্ব রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশ নয়। ইসলামবিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদীদের কূটচাল বাংলাদেশ নিয়েও দীর্ঘদিন থেকে চলছে। হঠাৎ করে কাউকে গ্রেফতার করে আইএস সদস্য হিসেবে প্রচার করা এবং চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের ধুঁয়া তুললেও এদেশে বাস্তবিকই জঙ্গিবাদ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য জঙ্গিবাদ রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। তাহলে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা কি নিজেরাই দেশে রেড এলার্ট জারী করছি না? বাংলাটিম, আনসারুল্লা, হুজি, জেএমবি, আইএস সদস্য হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পিতা এবং পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাদের সন্তানরা কখনোই জঙ্গী নয়। এমনকি একজন স্কুল শিক্ষক বলেছেন তার ছেলে খুবই ভীতু প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, তার ছেলে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যায়। সে কখনো জঙ্গি হতে পারে না। দু’জন পিতা বলেছেন, আমাদের ছেলেদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি ছিল না। দীর্ঘদিন আটকের পর যখন জঙ্গি হিসেবে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি। আরেক বিচারপতি আব্দুস সালাম তার ছেলে গ্রেফতারের পর বলেছেন, গ্রেফতার করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য তরুণদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ছেলে জঙ্গি বা আইএস সদস্য এমন অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। এ সব শুনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সকল অভিভাবকের কাছেই তাদের সন্তানরা নিরাপরাধ। কখন কে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা অনেক অভিভাবকই জানেন না। যারা এখন দাবি করছেন তাদের ছেলে নিরপরাধ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব ও একজন বিচারপতিও তার ছেলে জঙ্গি এমন খবরে বিস্মিত হয়েছে। আজ যে কর্মকর্তা ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তরুণদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয় দিচ্ছেন; কাল তার ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে না বা কেউ ষড়যন্ত্র করে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে একমত হয়ে বিশ্বের বহুদেশ এখন আইএস দমনে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলা, দ্বিমত প্রকাশ করা বা বিকল্প কোন চিন্তাভাবনা মনে হয়, অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ আইএসের নামটি নিলেই তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী। এরি মধ্যে পশ্চিমা জগতে অনেক লেখক, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক যতটুকু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা লেখালেখি করতে পারেন তার এক শতাংশও আরব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্ভব হয় না। পশ্চিমাদের এ সৌন্দর্য্য অনুন্নত বিশ্বে ঢাকা পড়ে যায় গোলামি সূলভ মানসিকতার কালো ছায়ায়। ব্রিটেনের এমপি রুশনারা আলী শ্যাডো মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই নেত্রী মূলত ব্রিটেনের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ও লন্ডনের জনমত, মুসলিম অনুভূতি এবং নিজ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে গত রমজানে গাজায় ফিলিস্তিনি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করেছিলেন ব্রিটেনের সহকারী মন্ত্রী সাইয়েদা সাঈদা ওয়ার্সি। সাইয়েদা ওয়ার্সি ও রুশনারা আলী দু’জনেরই পদত্যাগের কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ ও প্রতিবাদ। ওয়ার্সি গাজা প্রশ্নে ব্রিটেনের অস্পষ্ট নীতি আর রুশনারা আইএস নিমূর্লের যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের এ দুই তরুণী রাজনীতিকের মনোভাব যে গোটা বিশ্বের ন্যায়পন্থী নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন নয়, সেটাই বা কে বলবে? যে কোন ব্যানারে সংগ্রামরত মজলুম মানুষের ব্যাপারে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের রীতি আচরণ ও কর্মপদ্ধতি কি এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত কর্মকৌশলই কি অধিক ফলপ্রসূ না? এ নিয়ে পলিসি গবেষকরা যদি নতুন করে চিন্তাভাবনা না করেন তাহলে জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ শেষ না হয়ে বরং আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংক্ষুব্ধ মানবগোষ্ঠীর প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, মন্দের প্রতিবিধান করো ভালো দিয়ে। এতে তোমার শত্রু পরিণত হবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে। আর শত্রুকে বন্ধুরূপে তারাই পায় যারা ধৈর্য ধারণ করেন এবং যার জন্য নির্ধারিত আছে উত্তম নিয়তি। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জীবন সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠকে বিশ্বাসী লোকেরাই কি পশ্চিমাদের শত্রু? যদি তাই হয়, তাহলে বার বার বলতে হয় কেন যে, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, জিহাদিদের বিরুদ্ধে? যেখানেই যে অজুহাতেই লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছে তারা তো নিরীহ মুসলমান। বেসামরিক নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রুগীরাও তো রেহাই পায়নি। তাহলে এ ধরনের নীতির প্রতিক্রিয়ায় যদি দেশে দেশে তরুণেরা দুঃখ পায়, প্রভাবিত হয়, সমবেদনা বোধ করে তাহলে কি গ্রেফতার দমন-পীড়ন আর অপমানই এদের পাওনা? সাইবার মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তো রাষ্ট্রপূর্ণ সচেতন হয় না। সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও অব্যাহত জুলুম-নির্যাতন দেখে সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তিরও মনস্তাত্তিক সাপোর্ট, মটিভেশন এবং আদর্শিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিগত দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাই পছন্দ করে এসেছেন। সাজানো মামলা বা আরোপিত ধারায় ছাত্র, তরুণ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধরে মারাত্মক সন্ত্রাসী, জঙ্গি, তালিবান, আইএস ইত্যাদি বলে প্রচার করা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে বরং ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে মটিভেশনের কাজে লাগালে ফল ভালো হবে। অভিযুক্ত লোকেদের নিজ বাবা-মা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সাথে রেখে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ করলে উগ্রবাদ মোকাবেলা সহজ হবে।
বর্তমানে দেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যেখানে সেখানে যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আলেম ওলামা ধর্মীয় পোশাকধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তা ও শিক্ষিত লোকজন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন এবং মাদ্রাসা মসজিদের সঙ্গে জড়িত সেসব নাগরিক চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। খুশির কথা বলো দেশের তরুণ এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। সমাজে যখন উৎশৃংখলতা, আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চার নামে বেলেল্লাপনা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার ঢুকে পড়েছে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনায় উৎসাহী হচ্ছে। যারা ইসলামের দীক্ষায় এবং দ্বীনি পথে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করছেন তাদের জজ মিয়া বানিয়ে নাটক করা কখনোই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে দেশকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ ও সন্ত্রাস মুক্ত করা উচিত। আমি এমনও খবর পেয়েছি অনেক মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারের ভয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি-পাগড়ী পড়িধান না করে কলেজ পড়–য়া ছাত্রের মতো শ্যাট-প্যান্ট পরে বের হচ্ছে। দেশে যে সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং জীবনধারাকে গড্ডালিকায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে; তার চেয়ে শতগুণ বেশি তরুণ-তরুণী নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ও ড্রাগে আসক্ত হয়েছে। যাদের মাদকমুক্ত করে সমাজে সুনাগরিক করার চেয়ে ইসলামের প্রতি আসক্তদের গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়ার প্রতি অধিক মনোনিবেশ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, বিনিয়োগ, পর্যটন, সুনাম ইত্যাদি সবই বিশ্বদরবারে সংকটের সম্মুখিন হবে।
অতি উৎসাহী কিছু লোকের এসব প্রয়াস অতীতেও ছিল, ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর কী হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। অতএব সবার উচিত যথাযথভাবে কাজ করা।
কারো ছেলে যদি সত্যি সত্যি উগ্রবাদী হয়ে যায় এবং কারো স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ে যদি অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তাদের পিতামাতার হাতে তুলে দেয়াই অধিক ফলপ্রসু। তারা যাতে ভাল হয়ে যায় সে প্রতিশ্রুতি নেন এবং ওইসব পিতামাতার প্রতি আস্থা রাখুন। দেখবেন এক সময় তারা ভাল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ইসলামী তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞ লোক নেই। আমেরিকা আর ভারতে ট্রেনিং নিলে সেটা থাকার কথা নয়। ওইসব দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে কিছু লোকের স্বদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগের প্রচারণায় আমাদের দেশের অনেকেরই মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যাতে ওইসব দেশের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশকে বিদেশিদের চারণভূমি না বানিয়ে ফেলি, সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরাকে যারা এখন আইএস সদস্য, তারাই নিরীহ নাগরিক বাথ পার্টির লোকজন, তারা সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ২০০৩ সালের পর তারা কঠোর হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেন। আমার বিশ্বাস, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আমেরিকা প্রেসিডেন্ট ভোটের বৈতরণী পার হতে বর্তমানে যে কৌশল নিয়েছেন নভেম্বরে ভোটের পর তার পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিশ্বের মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিন্তাশীল মানুষ। তিনি অবশ্যই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। কারণ বর্তমানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর আমার নজরে পড়ে না। কেউ যদি ইসলামী ধ্যান-ধারণার মধ্যে থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে নিজেকে জড়ায় তাদের বোঝাতে হবে মূলত উগ্রাবাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত মানুষ এবং তরুণ যুবকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এদেশের মুসলমানরা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ নেই, তবে দ্বীন, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনো আপোষও নেই।
- See more at: http://dailyinqilab.com/2014/09/28/209039.php#sthash.QoCwcINC.dpufনিত্যদিনের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও দৈনিক যুগান্তরের লিড নিউজ ‘কোথায় ছিল এতোদিন’ রির্পোটটি পড়তে হলো। বাংলাদেশ জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে, এদেশের তরুণরা আইএস-এ যোগ দিতে যাচ্ছে এমন খবর যখন কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে; এ ধরণের খবর মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে ঠিকই; তখন ২৭ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরের এ অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের যেন ‘মুখোশ’ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের আইএস এ যোগদান এবং জঙ্গি হয়ে ওঠার ‘কল্পকাহিনী’ যারা মাঝে মাঝে ফাঁদেন তাদের চাতুর্যপনা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে পত্রিকাটি পরিবেশিত তথ্যে।
বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমারাই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা-ের নামে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে; মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের নামে জঙ্গিবাদ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তালেবান, আল কায়দা, আল শাবাব, আল নুসরা ইত্যাদি নামের সংগঠনকে ঠেকানোর নামে গোটা বিশ্বকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। মধ্যপাচ্যসহ বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রে সন্ত্রাস দমনের নামে লাখো মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে। কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে লাখ লাখ ইরাকী সুন্নি সিরিয়া, তুরস্কসহ পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ইরাকের সুন্নি নাগরিক ও বার্থ পার্টির লাখো সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছে। সুন্নী নারীদের নির্বিচারের ধর্ষণ করা হয় এবং ইরাকের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। সেগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মানবাধিকার লংঘন এবং সন্ত্রাসবাদ মনে হয়নি। চীন, ফিলিপাইন, আর্মেনিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তানে কি হচ্ছে তাতো মানুষ দেখছে। তখন শিক্ষিত যুবকরা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনকে জানা-বোঝার চেষ্টা করছে। নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে গড়ে তোলার অনুশীলন করছে। আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে দেশে দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করছে; প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের গায়ে জঙ্গী লেবেল এঁটে সন্ত্রাস দমনের ধোঁয়া তুলছে। ওবামা আইএসকে (ইসলামিক এস্টেট) দমন করতে হামলা চালিয়েছেন। একশ’ দেশ এই হামলায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো আইএস দমনের নামে নির্বিচার বিমান হামলার ঘোষণা কি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মধ্যে পড়ে না? মূলত অর্থ আর অস্ত্রের জোরে বিশ্বের মোড়ল খ্যাত আমেরিকা ও তার ধামাধরা দেশগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় মুসলমানদের উত্থান। বর্তমানে বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমানের বসবাস। পশ্চিমাদের অপরাজনীতি, বিধর্মপনা, বেলেল্লাপনা ও কূটকৌশলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে সেসব দেশে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোরআন নিয়ে গবেষণা বাড়ছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানুষ ইসলামমুখি হচ্ছে; দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। আর শান্তির ধর্ম ইসলামের বদনাম করতে কাল্পনিক জঙ্গিবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নির্মম হত্যা, ধ্বংস ও সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।
নভেম্বর মাসে আমেরিকার সিনেট নির্বাচন। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ওবামার জনপ্রিয়তা তলানীতি। সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের দেশে দেশে অকল্পনীয় সন্ত্রাস করে নিজ দেশের ভোটারদের বোঝাতে চাচ্ছে তারা দুর্বল নন। ব্রিটেনের ক্যামেরুন ভাল নেই। স্কটল্যা-ের নির্বাচনী ফলাফল মূলত তার পক্ষে যায়নি। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে তিনি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে মাফ চাইবেন। ফ্রান্সের ওঁলাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলনে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং সে সব দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে তারা সন্ত্রাস দমন আর মানবাধিকার রক্ষার নামে মুসলিম নিধনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ইরাকে আইএস কি একদিনই জন্ম নিয়েছে? শুধুমাত্র ইউরোপ থেকে তিন হাজারের বেশী তরুণ যুবক আইএস এ যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। তারা উচ্চ শিক্ষিত এবং আমেরিকা ব্রিটেনের মানবাধিকারের নমুনা দেখেছেন। আমেরিকার শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং মানবাধিকারের নমুনা দেখে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে সে দেশের বিবেকবান মানুষও বিক্ষুব্ধ। তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ যুবকরা ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছেন। যেভাবে এই অগ্রগতি হচ্ছে তাতে ২০৪০ সালের পূর্বেই আমেরিকায় সাদা চামড়ার ইসলামবিদ্বেষীরা মাইনরিটি হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কি বলে? আমেরিকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি এবং সেখানে প্রতিদিনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। নিজের ঘর সামাল দেয়ার বদলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তান দখল করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েমেন, সোমালিয়া, লিবিয়া, মিসরে আগুন জ্বালিয়েছে। সিরিয়ায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ তাদের সংজ্ঞায় মানবাধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক দখল এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি দেয়ার পর সে দেশে যে চরম মানবাধিকার লংঘন হয়েছে সে জন্য তাদের অনুশোচনা নেই। বীর আফগান জনগণের প্রতিরোধের কারণেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ভারতের জনগণের বিশাল অংশ মুসলমান। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদী আমেরিকা যাওয়ার আগে মুসলমানদের ব্যাপারে তার ইতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিদর্শন। জর্ডানে যারা ইরাক সিরিয়া থেকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সংখ্যা জর্ডানের মূল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ইসলাম প্রেমী এবং মুসলমানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে সেখানে বাড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশগুলোতে সমাজ বলতে তেমন কিছু নেই। সমকামী মানসিকতা, সামাজিক অবক্ষয়, লাম্পট্য বেড়ে যাওয়ায় সাদা চামড়ার জনসংখ্যা দিন দিন কমছে। এসব দেখে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ যুবকরা ইসলামের ছায়াতলে আসছে দলে দলে। এরাই মূলত সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সিরিয়ার শিয়া-সুন্নি বিরোধ আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে জিইয়ে রাখা প্রয়োজন। সে জন্য সেখানে আসাদ বাহিনীর হাতে দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেও তারা মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। মাত্র ৭% শিয়া আল ওয়াইদ এ পর্যন্ত ২ লক্ষাধিক সুন্নীকে হত্যা করেছে। ৯৩ ভাগ মানুষকে এই সংখ্যালঘুরা যেভাবে জুলুম করছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ইরাকের আইএস ইস্যু রাজনৈতিক সংকট। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক মিডিয়ার খবর যদি সত্যি হয়, আইএস স্কুল পুড়িয়েছে, সাংবাদিকের শিরñেদ করেছে, এগুলো গর্হিত কাজ। সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের কি হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেছে? তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লাখো মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই যে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন এসব সা¤্রাজ্যবাদীদের চোখে পড়েনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আইএস জুলুম-নির্যাতন সহ্যের এক পর্যায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওবামার নেতৃত্বে ১শ দেশ অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা বৈধ সাব্যস্ত করেছে এটা কেমন মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জন্য মার্কিনিদের দরদ যেন উথলে পড়ছে। অথচ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে; তাদের বাঁচানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সারাবিশ্বের ১৬টি দেশে ১৫৬টি সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠনের খেতাব দিয়েছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলোই তারাই সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। যখন ওই সংগঠনগুলো সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানছে তখন সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে দমনের চেষ্টা করছে। মূলত আমেরিকা ও তার তাঁবেদার দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের দেশের সংকট থেকে উত্তরণ এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাঝে মাঝে দেশে দেশে মুসলমানদের রক্ত ঝরানোর কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। জঙ্গির ধুয়া তুলে মুসলমানদের ওপর বোমা হামলা, বিমান হামলা করে মুসলিম নিধন করেন। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তাদের অধিনস্ত এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলো মিথ্যার বেসাতি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ধরে এ নীতি চালিয়ে আসছে ইসলামবিদ্বেষীরা। আমরা সে ফাঁদে পা দেব কেন?
আল কায়দার মুখপাত্র আয়মান আল জাওহিরির একটি রেকর্ড প্রকাশ করেছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। সেখানে তিনি এশিয়ায় সংগঠনের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমারা ‘সর্প হইয়া দংশন করে ওঁঝা হয়ে ঝাড়ে’ এই তাদের দ্বিমুখী নীতি তাদের। জাওহিরির এ ঘোষণার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা আমাদের পক্ষ্যে সত্যিই দুরূহ। এটি সরকারকেই নিরূপণ করতে হবে। এ ঘোষণার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি গ্রেফতার শুরু হয়। যুগান্তরের খবরের শিরোনামটি প্রণিধানযোগ্য। তারা লিখেছে ‘কোথায় ছিল এতোদিন’। সত্যিই অবাক করা প্রশ্ন। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বাংলা ভিশনের এক টকশোতে বলেছেন, বাংলাদেশে হঠাৎ হঠাৎ জঙ্গি আবিষ্কার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে হঠাৎ করে অস্ত্র উদ্ধার আর জঙ্গি গ্রেফতারের হিড়িক পড়েছিল। কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগে জঙ্গি ধরা শুরু হয়। আবার জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেও অস্ত্র উদ্ধারের মহড়া হয়। আসিফ নজরুলের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিশ্ব রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশ নয়। ইসলামবিদ্বেষী সা¤্রাজ্যবাদীদের কূটচাল বাংলাদেশ নিয়েও দীর্ঘদিন থেকে চলছে। হঠাৎ করে কাউকে গ্রেফতার করে আইএস সদস্য হিসেবে প্রচার করা এবং চিন্তাভাবনা না করেই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। পশ্চিমাদের অপপ্রচার এবং কিছু ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের ধুঁয়া তুললেও এদেশে বাস্তবিকই জঙ্গিবাদ আছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে না।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য জঙ্গিবাদ রয়েছে বলে প্রচার করা হয়। তাহলে আখেরে নিজেদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা কি নিজেরাই দেশে রেড এলার্ট জারী করছি না? বাংলাটিম, আনসারুল্লা, হুজি, জেএমবি, আইএস সদস্য হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পিতা এবং পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাদের সন্তানরা কখনোই জঙ্গী নয়। এমনকি একজন স্কুল শিক্ষক বলেছেন তার ছেলে খুবই ভীতু প্রকৃতির। আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, তার ছেলে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যায়। সে কখনো জঙ্গি হতে পারে না। দু’জন পিতা বলেছেন, আমাদের ছেলেদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি ছিল না। দীর্ঘদিন আটকের পর যখন জঙ্গি হিসেবে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয় তখন তাদের মুখে দাড়ি। আরেক বিচারপতি আব্দুস সালাম তার ছেলে গ্রেফতারের পর বলেছেন, গ্রেফতার করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য তরুণদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ছেলে জঙ্গি বা আইএস সদস্য এমন অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। এ সব শুনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সকল অভিভাবকের কাছেই তাদের সন্তানরা নিরাপরাধ। কখন কে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা অনেক অভিভাবকই জানেন না। যারা এখন দাবি করছেন তাদের ছেলে নিরপরাধ। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব ও একজন বিচারপতিও তার ছেলে জঙ্গি এমন খবরে বিস্মিত হয়েছে। আজ যে কর্মকর্তা ইসলামের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তরুণদের গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয় দিচ্ছেন; কাল তার ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠবে না বা কেউ ষড়যন্ত্র করে এমন করবে না তার নিশ্চয়তা কী?
মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে একমত হয়ে বিশ্বের বহুদেশ এখন আইএস দমনে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলা, দ্বিমত প্রকাশ করা বা বিকল্প কোন চিন্তাভাবনা মনে হয়, অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ আইএসের নামটি নিলেই তাকে বলা হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী। এরি মধ্যে পশ্চিমা জগতে অনেক লেখক, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক যতটুকু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ বা লেখালেখি করতে পারেন তার এক শতাংশও আরব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্ভব হয় না। পশ্চিমাদের এ সৌন্দর্য্য অনুন্নত বিশ্বে ঢাকা পড়ে যায় গোলামি সূলভ মানসিকতার কালো ছায়ায়। ব্রিটেনের এমপি রুশনারা আলী শ্যাডো মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এই নেত্রী মূলত ব্রিটেনের গণতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়েছেন ও লন্ডনের জনমত, মুসলিম অনুভূতি এবং নিজ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে গত রমজানে গাজায় ফিলিস্তিনি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে পদত্যাগ করেছিলেন ব্রিটেনের সহকারী মন্ত্রী সাইয়েদা সাঈদা ওয়ার্সি। সাইয়েদা ওয়ার্সি ও রুশনারা আলী দু’জনেরই পদত্যাগের কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ ও প্রতিবাদ। ওয়ার্সি গাজা প্রশ্নে ব্রিটেনের অস্পষ্ট নীতি আর রুশনারা আইএস নিমূর্লের যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদানের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনের এ দুই তরুণী রাজনীতিকের মনোভাব যে গোটা বিশ্বের ন্যায়পন্থী নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন নয়, সেটাই বা কে বলবে? যে কোন ব্যানারে সংগ্রামরত মজলুম মানুষের ব্যাপারে বিশ্বের ক্ষমতাধরদের রীতি আচরণ ও কর্মপদ্ধতি কি এক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত কর্মকৌশলই কি অধিক ফলপ্রসূ না? এ নিয়ে পলিসি গবেষকরা যদি নতুন করে চিন্তাভাবনা না করেন তাহলে জঙ্গিবাদ উগ্রবাদ শেষ না হয়ে বরং আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিরোধ নিষ্পত্তি ও সংক্ষুব্ধ মানবগোষ্ঠীর প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, মন্দের প্রতিবিধান করো ভালো দিয়ে। এতে তোমার শত্রু পরিণত হবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে। আর শত্রুকে বন্ধুরূপে তারাই পায় যারা ধৈর্য ধারণ করেন এবং যার জন্য নির্ধারিত আছে উত্তম নিয়তি। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী জীবন সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎকর্ষ এবং শ্রেষ্ঠকে বিশ্বাসী লোকেরাই কি পশ্চিমাদের শত্রু? যদি তাই হয়, তাহলে বার বার বলতে হয় কেন যে, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, জিহাদিদের বিরুদ্ধে? যেখানেই যে অজুহাতেই লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করা হয়েছে তারা তো নিরীহ মুসলমান। বেসামরিক নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রুগীরাও তো রেহাই পায়নি। তাহলে এ ধরনের নীতির প্রতিক্রিয়ায় যদি দেশে দেশে তরুণেরা দুঃখ পায়, প্রভাবিত হয়, সমবেদনা বোধ করে তাহলে কি গ্রেফতার দমন-পীড়ন আর অপমানই এদের পাওনা? সাইবার মাদক ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে তো রাষ্ট্রপূর্ণ সচেতন হয় না। সা¤্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন ও অব্যাহত জুলুম-নির্যাতন দেখে সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তিরও মনস্তাত্তিক সাপোর্ট, মটিভেশন এবং আদর্শিক শিক্ষা প্রয়োজন। বিগত দিনগুলোতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাই পছন্দ করে এসেছেন। সাজানো মামলা বা আরোপিত ধারায় ছাত্র, তরুণ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধরে মারাত্মক সন্ত্রাসী, জঙ্গি, তালিবান, আইএস ইত্যাদি বলে প্রচার করা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে বরং ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা ও অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনকে মটিভেশনের কাজে লাগালে ফল ভালো হবে। অভিযুক্ত লোকেদের নিজ বাবা-মা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সাথে রেখে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের সমম্বয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ করলে উগ্রবাদ মোকাবেলা সহজ হবে।
বর্তমানে দেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যেখানে সেখানে যখন তখন যাকে তাকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি পরিচয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আলেম ওলামা ধর্মীয় পোশাকধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তা ও শিক্ষিত লোকজন এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। যারা ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন এবং মাদ্রাসা মসজিদের সঙ্গে জড়িত সেসব নাগরিক চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। খুশির কথা বলো দেশের তরুণ এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। সমাজে যখন উৎশৃংখলতা, আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চার নামে বেলেল্লাপনা এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার ঢুকে পড়েছে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আসছে। তারা ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে এবং ইসলামের অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনায় উৎসাহী হচ্ছে। যারা ইসলামের দীক্ষায় এবং দ্বীনি পথে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করছেন তাদের জজ মিয়া বানিয়ে নাটক করা কখনোই সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে দেশকে প্রকৃত অর্থে অপরাধ ও সন্ত্রাস মুক্ত করা উচিত। আমি এমনও খবর পেয়েছি অনেক মাদ্রাসার ছাত্র গ্রেফতারের ভয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি-পাগড়ী পড়িধান না করে কলেজ পড়–য়া ছাত্রের মতো শ্যাট-প্যান্ট পরে বের হচ্ছে। দেশে যে সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং জীবনধারাকে গড্ডালিকায় না ভাসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে; তার চেয়ে শতগুণ বেশি তরুণ-তরুণী নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ও ড্রাগে আসক্ত হয়েছে। যাদের মাদকমুক্ত করে সমাজে সুনাগরিক করার চেয়ে ইসলামের প্রতি আসক্তদের গ্রেফতার করে জঙ্গি তকমা দেয়ার প্রতি অধিক মনোনিবেশ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, বিনিয়োগ, পর্যটন, সুনাম ইত্যাদি সবই বিশ্বদরবারে সংকটের সম্মুখিন হবে।
অতি উৎসাহী কিছু লোকের এসব প্রয়াস অতীতেও ছিল, ক্ষতি ছাড়া লাভ হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর কী হয়েছে তা দেশের মানুষ দেখেছে। অতএব সবার উচিত যথাযথভাবে কাজ করা।
কারো ছেলে যদি সত্যি সত্যি উগ্রবাদী হয়ে যায় এবং কারো স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ে যদি অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তাদের পিতামাতার হাতে তুলে দেয়াই অধিক ফলপ্রসু। তারা যাতে ভাল হয়ে যায় সে প্রতিশ্রুতি নেন এবং ওইসব পিতামাতার প্রতি আস্থা রাখুন। দেখবেন এক সময় তারা ভাল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ইসলামী তাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞ লোক নেই। আমেরিকা আর ভারতে ট্রেনিং নিলে সেটা থাকার কথা নয়। ওইসব দেশে ট্রেনিং নিয়ে এসে কিছু লোকের স্বদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগের প্রচারণায় আমাদের দেশের অনেকেরই মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যাতে ওইসব দেশের ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশকে বিদেশিদের চারণভূমি না বানিয়ে ফেলি, সে বিষয়টি চিন্তায় আনা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইরাকে যারা এখন আইএস সদস্য, তারাই নিরীহ নাগরিক বাথ পার্টির লোকজন, তারা সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ২০০৩ সালের পর তারা কঠোর হন এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেন। আমার বিশ্বাস, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ আমেরিকা প্রেসিডেন্ট ভোটের বৈতরণী পার হতে বর্তমানে যে কৌশল নিয়েছেন নভেম্বরে ভোটের পর তার পরিবর্তন ঘটবে। তারা বিশ্বের মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত্র করে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিন্তাশীল মানুষ। তিনি অবশ্যই বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। কারণ বর্তমানে যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্যে এমন চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ আর আমার নজরে পড়ে না। কেউ যদি ইসলামী ধ্যান-ধারণার মধ্যে থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে নিজেকে জড়ায় তাদের বোঝাতে হবে মূলত উগ্রাবাদ ও জঙ্গিবাদ কখনো ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। অহেতুক ভয় দেখিয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত মানুষ এবং তরুণ যুবকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখা উচিত নয়। বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এদেশের মুসলমানরা কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করেছে। ইসলামে উগ্রবাদ নেই, তবে দ্বীন, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে কোনো আপোষও নেই।
No comments:
Post a Comment