দীপায়ন খীসা ::
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি আজ ২ ডিসেম্বর। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চার খণ্ডে সম্পাদিত এই চুক্তিকে ঘিরে পাহাড়ের মানুষ নতুন এক সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনেছিল। দীর্ঘ শরণার্থী জীবন কাটিয়ে নিজভূমে ফিরেছিল হাজারো মানুষ। আশা-জাগানিয়া হতে চেয়েছিল পাহাড়ের চিরদুঃখী জুম্ম জনগণ। এই ১৮ বছরে আশার বীজটি অনেক ডালপালা ছড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু খেরোখাতা সে কথা বলে না। মেলে না অনেক হিসাব।
চার খণ্ডে সম্পাদিত চুক্তিটি একটি কাগুজে দলিল হিসেবে পড়ে আছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দু'পক্ষের মধ্যে জনসংহতি সমিতি তাদের অংশের দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে অস্ত্র সমর্পণের বিষয়টি জনসংহতি সমিতি সম্পন্ন করেছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র আন্দোলন থেকে নিয়মতান্ত্রিক পথে ফিরে এসেছে। কিন্তু চুক্তির অপরাপর শর্ত এবং ধারা-উপধারা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। এই দীর্ঘ ১৮ বছরেও সরকার সেই পথে হাঁটেনি। সরকারি নীতিনির্ধারকদের কথার ফুলঝুরিতে কিংবা আমলাদের মারপ্যাঁচে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া একটি বূ্যহচক্রে পাক খাচ্ছে। সেই বূ্যহচক্রে আটকে আছে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
তাই এখন আবার চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকে নতুন লড়াইয়ের পথে পা বাড়াতে হচ্ছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েই চলেছে। পাহাড়ে বেসামরিকীকরণ করা হয়নি। দীর্ঘ ১৮ বছরে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনটিও চূড়ান্ত হয়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সে তো দূর অস্ত। চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ তিন পার্বত্য জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তর। কিন্তু সেটাও নখদন্তহীন করে রাখা হয়েছে। সরকার আঞ্চলিক পরিষদের বিধিমালাও ঝুলিয়ে রেখেছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও বিভিন্ন সময়ে নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য একটি টাস্কফোর্স কাজ করার কথা ছিল। সেই টাস্কফোর্স আছে তবে তা শুধু সরকারিভাবে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ এই ১৮ বছরে পরিলক্ষিত হয়নি। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পাহাড়ে পৃথক ভোটার তালিকা করার বিষয়ে তো কোনো পদক্ষেপই নেই। এ বিষয়ে কোনো আইনই প্রণয়ন হয়নি। পার্বত্য চুক্তির যেটি সাধারণ ধারা সেখানে বলা হয়েছে, পার্বত্য এলাকা জুম্ম জনগণের অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হবে। এই বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এ চুক্তির অন্যতম প্রধান কাজ বলে ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো পাহাড়ের জুম্ম জনগণ ক্রমান্বয়ে ভূমি হারাচ্ছে, উচ্ছেদ হচ্ছে, সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। পাহাড়ে বর্তমানে অভিবাসী বাঙালি জনগণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকলে পাহাড়ের জুম্ম জনগণ অচিরেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে শহর এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে পৌরসভা, উপজেলা সদর এবং জেলা সদরগুলোতে জুম্ম জনগণ সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। জনমিতির এই পরিবর্তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল স্পিরিটের বিপরীত প্রতিচ্ছবিই আমাদের কাছে ধরা পড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ইতিহাস বিচারে এই দেশবাসীর জন্য এক অমূল্য অর্জন। কিন্তু সরকারের খামখেয়ালিপনা এই অনন্য অর্জনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে চলেছে। ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর চুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে সুুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করার জন্য সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেন। তা না হলে ২০১৫ সালের মে মাস থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সরকার জনসংহতি সমিতির আহ্বানে সাড়া দেয়নি। গত ২৮ নভেম্বর চুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তির সংবাদ সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি বলেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে। এমতাবস্থায় জনসংহতি সমিতি কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এরই মধ্যে পাহাড়ে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। হাটবাজার, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জনের কয়েক দফা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার বিশিষ্ট নাগরিকরা অসহযোগের সমর্থনে প্রতীকী অনশন করেছেন। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে জনগণের ব্যাপক সমর্থন লক্ষণীয়।
চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এই গড়িমসি তার নির্বাচনী অঙ্গীকারকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ১৯৯৭ সালে যখন চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখন আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল। চুক্তি স্বাক্ষর থেকে এই নিয়ে দলটি তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের দায়বদ্ধতা অবশ্যই থেকে যায়। কিন্তু দলটি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। সততার পরিবর্তে তারা শঠতা-কপটতার আশ্রয় নিয়েছে। কখনও আশি শতাংশ, কখনও নব্বই শতাংশ চুক্তি বাস্তবায়ন করেছে বলে বিভ্রান্তমূলক তথ্য পরিবেশন করছে। সরকারকে বুঝতে হবে এই বিভ্রান্তি তাদের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। পাহাড়ের মানুষ অনন্তকাল তীর্থের কাকের মতো চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতীক্ষা করবে না। পাহাড়ের জনগণ প্রতারিত বোধ করে ক্ষোভে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। এই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে সরকারের জন্য তা সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিছক একটি কাগুজে দলিল নয়। জুম্ম জনগণের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেরই ফসল এই চুক্তি। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের দায়মোচনের জন্যও এই চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরি। তার অন্যথা হলে সেটা হবে প্রতারণা। শতাংশ বা অঙ্কের হিসাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হয় না। চার খণ্ডে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন শতকষার বূ্যহচক্রে আটকে রাখার দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী
সধৎিঁস@যড়ঃসধর.পড়স
সূত্র : দৈনিক সমকাল, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫
No comments:
Post a Comment