ড.মিল্টন বিশ্বাস ::
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় যা সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেই অঞ্চলের সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি ঘটায় বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। একই সাথে এই উপলক্ষে প্রাপ্ত ইউনেস্কো পুরস্কার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনে এক অনন্য স্বীকৃতি। এ চুক্তির পরই পুরো পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশনায় বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবুও কিছু স্বার্থান্বেষীমহল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াশ চালিয়ে থাকে। যেমন, ৩টি ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ গঠন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩ দপ্তর/সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি দপ্তর/সংস্থা হস্তান্তর করা হয়েছে। ১২,২২৩ জন শরণার্থী পুনর্বাসন এবং শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যদেরকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অধিকাংশ ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে। অনুদান প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা প্রবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মনিটরিং কমিটি ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এভাবে আমরা একটির পর একটি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সেখানকার উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে পারি।
কিন্তু আমরা জানি যে, শান্তিচুক্তির পর সেই সময়কার আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পও বৃদ্ধি করেনি। বর্তমানেও চলমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বরং চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতে ইউপিডিএফ ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করছে। আবার তাদের রুখতে অন্যেরা অস্ত্র ধরেছে। অথচ ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। এক সময় বিভিন্ন দলের ভেতর কোন্দল এবং বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়ায় চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। কিন্তু তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে সামনে রেখে সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবনে অভ্যস্ত বিচিত্র দলের কর্মীরা অপতত্পরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাঝে-মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যার এখন পর্যন্ত সমাধান হয়েছে। সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি-বাঙালিদের প্রতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিরা সদয় দৃষ্টি দেবে—এ প্রত্যাশাও রয়েছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের জনশক্তির।
উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নসমূহ পার্বত্য এলাকায় সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। ইতোমধ্যে ৪৪২.২২ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে; নির্মাণ কাজ চলছে আরো ১৪০.৭১৭ কিলোমিটারের। শান্তিচুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। চাকমা উপজাতির জন্য মোট প্রকল্প ১৮৬ টি(৪৫%), অন্য উপজাতিগুলোর জন্য মোট প্রকল্প ১৯৪টি(৪৬%)। অর্থাত্ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৮০টি(৯১%)। পক্ষান্তরে বাঙালিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৬ টি (৯%)। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে ১২টি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা রয়েছে। গত ১৮ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর যাবত্ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মধ্যে প্রত্যেক ধর্মীয় সমপ্রদায়কে নিজ নিজ ধর্ম পালনে উত্সাহী করেছেন। এজন্য উপজাতিরা তাঁর কাছে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে- এটাই স্বাভাবিক। কয়েক বছর আগে কক্সবাজার জেলার রামুসহ টেকনাফ, পটিয়া ও উখিয়ায় দুষ্কৃতকারীরা দল বেঁধে বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটালে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তিনি; ঘটনার পর নিজে সেখানে উপস্থিত হয়ে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার।
শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা সচেষ্ট। সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের কোনো অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী উদ্যোগ নেই। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। ভূমি কমিশন গঠন ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সমপ্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নিয়েছে। এর আগে একাধিকবার স্বার্থান্বেষীমহলের প্ররোচনায় পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। মূলত পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাছে প্রিয় এলাকা। পাহাড়ি উপজাতিরা যদি সমতলের বাঙালিদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং অনুপ্রবেশকারী মনে করে, তাহলে তা হবে আত্মঘাতী। এ জন্য কেবল শেখ হাসিনা সরকারকে দোষারোপ করে নিজেদের দায় এড়াতে পারবেন না সন্তু লারমা ও তাঁর সমর্থকরা।
লেখক :অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
উৎস দৈনিক ইতেফাক, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫
No comments:
Post a Comment