Saturday, December 5, 2015

আঠারো বছর কি খুব কম সময়?


সোহরাব হাসান ::
     
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সইয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দেন জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সইয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দেন জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাবাংলাদেশে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম উচ্চ ডিগ্রিধারী এস এস চাকমার সঙ্গে পরিচয় দুই দশকের বেশি সময় আগে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে তিনি ছিলেন ভুটানে রাষ্ট্রদূত। তারও আগে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর নেন। অবসরের পর থেকে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে তাঁর বেশ কটি বই আছে।
সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে শান্তি–প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির নেপথ্যে তাঁর সক্রিয় ভূমিকাও সবার জানা। এস এস চাকমা প্রচণ্ড আশাবাদী ও স্পষ্টবাদী মানুষ। ব্যক্তিগত কারণে তিনি খুব একটা টেলিফোন করেন না। টেলিফোন করেন তখনই, যখন পাহাড়ে কোনো হামলা, সংঘর্ষ বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ভাবেন, সংবাদপত্রে এসব খবর ছাপা হলে প্রশাসনের টনক নড়বে এবং আক্রান্ত মানুষ প্রতিকার পাবে। কয়েক দিন তাঁর টেলিফোন না পেলে এই ভেবে স্বস্তিবোধ করি যে তাহলে পাহাড়ে কোনো অঘটন ঘটেনি। কিন্তু সেই স্বস্তি স্থায়ী হয় না। মাঝেমধ্যেই তাঁর টেলিফোন থেকে অঘটনের খবর জানতে পারি। হালের অঘটন হয়তো পেছনের অঘটনের কথা ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু আক্রান্ত মানুষগুলোর খেদ ও ক্ষত মুছে যায় না।

পার্বত্য চুক্তির ১৮ বছর পূর্তি ছিল ২ ডিসেম্বর। এ উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়ে পাহাড়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছেন। রাজধানী ঢাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। এসব আয়োজন থেকে জনসংহতি সমিতির নেতারা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। আবার সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন হবেই। ১৮ বছর আগে যে চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে পাহাড়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান ঘটাল, যে চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গৌরব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ইউনেসকো পুরস্কার নিয়ে এল, সেই চুক্তি নিয়ে দুই পক্ষের এই মুখোমুখি অবস্থান খুবই বেদনাদায়ক।

আজ আমরা যখন পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া না-হওয়া নিয়ে আলোচনা করছি, তখন এর পেছনের রক্তাক্ত ইতিহাসকে ভুলে যাচ্ছি না। সেখানে প্রায় দুই দশক ধরে চলা সংঘাত বহু পাহাড়ি ও বাঙালির জীবন কেড়ে নিয়েছে, বহু মানুষকে উন্মূল ও উদ্বাস্তু করেছে। তার চেয়েও বেদনাবহ হলো একই দেশের দুটি জাতিগোষ্ঠী একে অপরের মধ্যে হিংসা ও ঘৃণা পুষে রাখার ঘটনা। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়েছে বলেই সরকার দাবি করে। আমরা এও ভুলে যাচ্ছি না যে সে সময়ে বাঙালি ও পাহাড়িদের উগ্রপন্থী অংশ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। উগ্রপন্থী বাঙালি, যারা পাহাড়ের বাইরে নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে বড় করে দেখে, তারা প্রচার চালিয়েছিল যে এই চুক্তি হলে দেশের এক-দশমাংশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। আর পাহাড়িদের উগ্রপন্থী অংশ চুক্তির বিরোধিতা করেছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার কারণে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে চুক্তির জোরালো সমর্থক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, ন্যাপ, জাসদসহ বিভিন্ন বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলো। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের নিরস্ত্র করে চুক্তি সই করতে বেগ পেতে হয়েছিল জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাকেও। কিন্তু ১৮ বছর পর এসে যখন দেখা যায়, চুক্তির মূল ধারাগুলো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে এবং পাহাড়ে নতুন করে বিধিনিষেধ জারি হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই চুক্তির সমর্থকেরা যেমন হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন, আর উৎফুল্ল হন চুক্তির বিরোধিতাকারীরা। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মধ্যে অন্যতম বিভাজনরেখা ছিল পার্বত্য চুক্তি। সেই বিভাজনরেখাটি মুছে যাবে, না আরও স্পষ্ট হবে, সেটি নির্ভর করবে চুক্তি বাস্তবায়ন করা না-করার ওপর।

এবারে পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তিতে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা, যিনি ছিলেন শান্তিবাহিনীর প্রধান, তিনি বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের নামে গত ১৮ বছর কেবল টালবাহানা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়েও জুম্ম জনগণ মুক্তিলাভ করেনি। সরকার যে সমস্যার জন্ম দিয়েছে, সেই সমস্যা সরকারকেই সমাধান করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে হরতাল, অবরোধ, অফিস–আদালত বর্জন, ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিরোধসহ ১০ দফা কর্মসূচিও দিয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, যিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টিও দেখাশোনা করেন, ২ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে আয়োজিত সমাবেশে বলেছেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। সন্তু লারমার প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ‘তিনি একজন দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষ। তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।’ গওহর রিজভীর এই বক্তব্য যদি সরকারেরই কথা হয়ে থাকে, তা হলে চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

পার্বত্য চুক্তির দুটি পক্ষ। একটি সরকার ও অপরটি জনসংহতি সমিতি। জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমার বিরুদ্ধে সরকারের যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, এ কথা কেউ বলছেন না যে তিনি চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন। এমনকি সেখানে পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তিবিরোধী বলে পরিচিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সরকারের চেয়েও কঠিন। জনসংহতি সমিতি মনে করে, সরকারই এই জনসমর্থনহীন সংগঠনটি টিকিয়ে রেখেছে। আবার ইউপিডিএফের অভিযোগ, সন্তু লারমা চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে পাহাড়িদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন। পাহাড়ে এখন ইউপিডিএফের সঙ্গে সরকার বা সরকারি বাহিনীর যত সংঘাত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় জনসংহতি সমিতির সঙ্গে। তারা একে অপরকে সরকারের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। আর এসব সংঘাতের মূলে রয়েছে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া। পাহাড়ি নেতারা এখন বিভক্ত; কেউ সরকারের পক্ষে, কেউ সন্তু লারমার। কখন কী হয় সে নিয়ে সাধারণ পাহাড়িরা উদ্বিগ্ন।

চুক্তি সইয়ের পর সেনা-সমর্থিত দুই বছর বাদ দিলে বাকি পাঁচ বছর বিএনপি এবং ১১ বছর আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। সে ক্ষেত্রে চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তার কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের পাওনা আর বাস্তবায়িত না হলে তার বদনামও তাকে নিতে হবে। যুক্তির খাতিরে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে চুক্তিবিরোধী বিএনপি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে সেই যুক্তি মোটেই খাটে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় মোবাইল ফোন চালু করে, যা তথাকথিত নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পূর্ববর্তী সরকারগুলো বন্ধ রেখেছিল। চুক্তির বিরোধিতাকারী বিএনপি এখন সংসদেও নেই, রাজপথেও নেই বা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নিজের সমস্যা নিয়ে এত ব্যস্ত যে পাহাড়িদের নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। আর সরকারের দুই ছোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে বরাবরই সোচ্চার। অতএব, এ কথা বলার সুযোগ নেই বিরোধী দলের নাশকতার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে সরকারের ভেতরেই এমন কোনো মহল আছে, যারা চায় না শেখ হাসিনার সময়ে সই করা চুক্তিটি বাস্তবায়িত হোক; পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসুক।

সরকার দাবি করছে, পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগই তারা বাস্তবায়িত করছে। তাহলে গত ১৮ বছরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচনটি কেন হলো না? জেলা পরিষদ নির্বাচন না হলে আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনও করা যাচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী তিন আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধিরাই আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচন করবেন। চুক্তিতে বলা আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতীয়’ এবং বাঙালিদের মধ্যে যারা স্থায়ী বাসিন্দা, তাদের নিয়ে ভোটার তালিকা হতে হবে। কিন্তু কারা স্থায়ী বাসিন্দা ও কারা সেটেলর, সেটা এখনো মীমাংসা হয়নি। সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি যে গঠন করা হয়, তা কালেভদ্রে বসলেও ফলাফল দেশবাসী জানে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মূলে ভূমির মালিকানা বিরোধ। সেখানকার বাসিন্দারা বংশপরম্পরায় যে ভূমি ব্যবহার করে আসছেন, সেই দখলি সূত্রেই তাঁরা তার মালিক। সমতল ভূমির মতো তাঁদের কোনো দলিল বা কাগজপত্র নেই। এই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা যায়নি, এমনকি কমিশনের বিধি জারির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। এ অবস্থায় চুক্তি কীভাবে ও কত দিনে বাস্তবায়িত হবে কিংবা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, সেই প্রশ্ন পাহাড়িদের তাড়া করে ফিরছে।

চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যেটি জরুরি তা হলো সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক, আলোচনা। কিন্তু জনসংহতি সমিতি নেতাদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দু-একজন ছাড়া কেউ বসারই প্রয়োজন বোধ করেন না। সে ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান কঠিনই বৈকি। দেশের বাইরে ও ভেতরে ব্যাপকভাবে নন্দিত চুক্তির বাস্তবায়ন এভাবে ঝুলিয়ে রাখলে যেকোনো সময়ে শান্ত পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।
পার্বত্য চুক্তি সই হওয়ার পর শেখ হাসিনা তিন বছর আট মাস ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় শরণার্থী পুনর্বাসন, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ গঠন, শান্তিবাহিনীর সদস্যদের কর্মসংস্থানসহ অনেক কাজই হয়েছিল। তারপরও অনেক সময় পার হয়ে গেছে, একের পর এক সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য সমস্যার মূলে কেউ হাত দিয়েছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবতই প্রশ্ন ওঠে, একটি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আঠারো বছর কি খুব কম সময়?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক
sohrabhassan55@gmail.com

উৎস : দৈনিক প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ 

No comments:

Post a Comment