শামীমা বিনতে রহমান ::
আসামের জাতিগত সংঘাতের আঁচটা একটু বেশিই উত্তর প্রদেশে। এখানে মুসলমানদের সংখ্যা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় যথেষ্ঠ বেশি, ৪০ লাখ ছাড়ানো। রাজধানী শহর লাক্ষ্ণৌতে ঈদ উত্তর এক আড্ডায়, যেটা শৈশবের বন্ধুদের আড্ডা এবং যেখানে ধর্মীয় পরিচয় কোনভাবেই প্রাধান্যের না, সেই আড্ডায় ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু এবং মুসলমান বন্ধুদের উল্লাস এসে থমকে দাঁড়ায় আসামে।
মানে আসাম প্রসঙ্গে। সেখানকার বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর সাথে বাংলাভাষি মুসলমান সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের বিষয়টি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় রূপ নিয়ে নিতে পারে এমন আশঙ্কা। আড্ডায় লাক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে চাকরির খোঁজকারি নির্মাণ ডি সিন বললো, ওখানে তো হিন্দু মুসলমান সংঘাত হয় নাই। ওখানে তো বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর সাথে সেটেলার বাঙ্গালিদের সংঘর্ষ হয়েছে। তাহলে সাইটগুলোতে মুসলমানরা হিন্দুদের মেরে ফেলছে- এরকম ক্যান বলা হয়েছে?’
এইরকম প্রশ্ন উঠে আসছে অনেকের মধ্যেই। আসামের বাইরে অনেকের কাছেই, যারা সংবাদ মাধ্যমে আসামের জাতিগত সংঘাতের খবর দেখেছেন বা পড়েছেন, তারা ঠিক বুঝতে পারছেন না, এটাকে কেন ধর্মীয় সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারা নিচ্ছে? তবে সংঘাতের আশঙ্কা থরো থরো, সবার মনে। আসাম যেখানটায়, সেই উত্তর পূর্ব ভারত বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক মনে করেন, এটা পুরোপুরি বিজেপির কাজ। তিনি বলেন, ‘এই সংঘর্ষের জের ধরে ভারতের ব্যাঙ্গালুর, মুম্বাইতে যেসব সংঘর্ষ হয়েছে, তার পেছনেও এই বিজেপি আর শিবসেনা। উত্তর পূর্ব ভারতের রাজনীতি না বুঝে এটাকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করছে এরা। এটা আদতে সফল হবে না, কারণ ওখানকার সহিংসতা ধর্মকে কেন্দ্র করে না।’
গত ১৬ জুলাই আসামের মুসলমান প্রাধান্যের অল বোড়োল্যান্ড মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামে দুই ছাত্র সংগঠনের নেতা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এই সংঘাত শুরু হয়। বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর সাথে বাংলাভাষি মুসলমানদের। এরপর এখন পর্যন্ত ৭০ জনের মতো মারা গেছে। আর ঘর বাড়ি ছেড়ে দেশান্তরি হয়েছে প্রায় ৫ লাখ।
কেন এই সংঘাত? আসামের সংঘর্ষ বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে আদিবাসীরা যেমন তাদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বসবাস করার জন্য স্বায়ত্ব শাসন চেয়ে আসছে বহু বছরের রক্তক্ষয়ি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, আসামে বোড়ো জাতিগোষ্ঠী বোড়ো ল্যান্ডে স্বায়ত্ব শাসন পেলেও তারা মেনে নিতে পরছিল না কোন জাতিগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ। যদিও সেখানে বাঙ্গালিদের এই অনুপ্রবেশ অনেক পুরানা সময়ের। ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই।
আসামের তেল, চায়ের মতো অনেক সম্পদের মধ্যে একটা বড় সম্পদ তাদের আবাসযোগ্য সমতল ভূমি আর বাংলাদেশের অনেক সমস্যার মধ্যে একটা বড় সমস্যা জমি এবং জীবিকার অভাব। তাই বাংলাদেশ সীমান্তের পাশ ঘেঁষা আসামের ধুবরি জেলায় যেখানে কোকরাঝাড়, চিরান, উদালগিরি জায়গাগুলার অবস্থান এবং যেটি বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর মূল অঞ্চল, সেখানটায় বাংলা ভাষি, বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ ঘটে আসছে দীর্ঘ কাল ধরে, ধর্মীয় পরিচয়ে যারা বেশিরভাগ মুসলমান। এবং এরা সমতলে কারিগরি দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে বোড়োদের চাইতে এগিয়ে।
বোড়োরা আসামের আদি বসতি স্থাপনকারী জনগোষ্ঠী। সমতলের এই আদিবাসী আসামের ৪২ টি ভাষাভাষির অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্রম্মপূত্র নদীর উত্তর পাড় ঘেঁষে এই সমতলের আদিবাসীরা ভারত ভাগের আগ থেকেই একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম ভূমির জন্য লড়াই করে আসছে। আসামে বোড়োল্যান্ড নামে বোড়োদের একটি জায়গা আছে, যেটি বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অটোনম্যাস ডিস্ট্রিক্ট বা বিটিএডি নামে পরিচিত, যার অর্ন্তগত হলো কোকরাঝাড়, চিরান, বাকসা এবং উদালগিরি আর এর রাজধানি ধরা হয় কোকরাঝাড়কে আর কোকরাঝাড়ই এবারের সংঘাতের মূল কেন্দ্র। টাইমস অফ ইন্ডিয়া কোলকাতার প্রিন্সিপাল করসপনডেন্ট সিজার মন্ডল ওখানে সংঘাতের পর থেকেই নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহে থাকছেন। বললেন, ‘সমস্যাটা কিন্তু কোন ভাবেই হিন্দু মুসলমানের না। এটি জাতিগত সংঘাত। বোড়োরা কোনভাবেই তাদের ভূমিতে অন্য কারো আধিপত্য, অনুপ্রবেশ মেনে নিতে পারে না। এর আগে তারা সাঁওতালদের সাথেও সংঘাতে গেছে। মুসলমান ধর্মের বাংলাভাষিদের আধিপত্য ওদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই মেনে নেয়া সম্ভব না। ওখানে অটোমেটিক রাইফেলের ব্যবহার হয়েছে। এটা প্রমাণ করে এটা পরিকল্পিত। ওখানে সক্রিয় আছে ইনসার্জেন্ট গ্রুপ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড বা এনডিএফবি, যারা সার্বভৌমত্বের আন্দোলন করে আসছে বহুদিন থেকে। অর্থাৎ, এটা বোড়ো জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংঘাত, ধর্মীয় সম্প্রায়গত সংঘাত না।‘
বোড়োরা সশস্ত্র সংঘাতে এর আগেও গেছে। ১৯৯৩ সালে পশ্চিমের জেলা বনগাই গাঁওয়ে। তখনও সেটেলার বাঙ্গালি মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষ, প্রায় ৫০ জন মারা যায়। ১৯৯৪ সালে বারপেটা জেলায়, প্রায় ১০০ জন মারা যায়। ১৯৯৬ সালে কোকরাঝাড় এবং বনগাই গাঁওয়ে সাঁওতালদের সাথে সহিংসতায় ২০০র বেশি লোক মারা যায়। ১৯৯৮ সালে সাঁওতালদের সাথে সংঘর্ষে মারা যায় ৫০ জনের মতো। ২০০৮ সালে দারাং এবং উদালগিরিতে মুসলমান বাঙ্গালিদের সাথে সংঘর্ষে মারা যায় প্রায় ৭০ জন। এ বছরও বাংলাভাষি মুসলমানদের সাথে বোড়োদের সংঘর্ষ বাঁধে, আধিপত্য বিস্তার প্রতিরোধেই। বোড়োরা বেশিরভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বি, কিছু হিন্দু আর কিছু খ্রিষ্টান। সাংবাদিক সিজার মন্ডল বললেন, ‘এখানে সেটেলার বাঙ্গালিদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান, যাদের সাথে বোড়োদের সংঘর্ষ। এটাকেই ক্যাশ করে মৌলবাদি সংগঠনগুলো তাদের ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে। এখন যা হচ্ছে, সবই পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। ভারত ভিত্তিক হিন্দু মৌলবাদি আর পাকিস্তান ভিত্তিক মুসলিম মৌলবাদি সংগঠনগুলো এখন পরিকল্পিতভাবে সাধারণদের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা ভুলে যাই নি, বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা পরিস্থিতির পর।’
ভারতে পরিস্থিতি এখন যেমন: আসামের বোড়োদের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন ভারতের অন্যান্য অংশে ধর্মীয় রং নিয়ে আভির্ভূত হয়েছে। মোবাইল ফোনের এসএমএস, এমএমএস দিয়ে এবং ইন্টারনেটভিত্তিক কিছু ওয়েব সাইটের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের ঘৃণা। এসব ওয়েব সাইটে তিব্বতের সহিংসতার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, মিয়ানমারের বৌদ্ধ-মুসলমানদের সংঘর্ষের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত সরকার প্রথম দিকে, মানে ১৯ অগাস্ট থেকে ২৩ অগাস্ট পর্যন্ত ৫টি করে এসএমএস ব্যবহার করা সীমাবদ্ধ করেছিল এরপর ২৪ অগাস্ট থেকে সীমানা ঠিক করেছে ২০টি। ২৪০টির মতো সাইট ব্লক করেছে। কিন্তু কারা এই ইস্যুকে ব্যবহার করে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে উস্কে দিচ্ছে, তা এখনও বের করতে সমর্থ হয় নি। লাক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণ যোগাযোগ বিভাগের প্রধান মুকুল শ্রীবাস্তব মনে করেন, ‘প্রায় আড়াইশর মতো সাইট বন্ধ করে দেয়াটাই যথেষ্ঠ নয়। সাধারণভাবে বোঝা যায়, ভারতের আরএসএস এবং পাকিস্তান ভিত্তিক মুসলিম উগ্র সংগঠনগুলো উস্কানির সাথে যুক্ত। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে না পারলে এটা ভয়াবহ সহিংসতার দিকে মোড় নেবে, যার শিকার সাধারণ মানুষই হবে।’
একই প্রসঙ্গে সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের নজর উত্তর পূর্ব ভারতের পরিস্থিতির দিকে। তিনি বলেন, ‘ঝামেলাটা সহজে যাবে না। প্রায় ৫ লাখের মতো লোক বিতাড়িত হয়েছে। বড় অংশ মুসলমানরা ফিরতে পারবে না, কারণ বলা হচ্ছে, ওরা ভারতীয় নাগরিক কি-না যাচাই করে ঢুকানো হবে। এই জাতিগত সংঘর্ষ উত্তর পূর্ব ভারতকে গৃহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment